শিশু অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা

মো. মমিনুল হক: ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’- এটি বহুল চর্চিত উক্তি। আবার এটিও বলা হয়, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। মোদ্দা কথা, শিশুরাই হলো পৃথিবীতে মানবজাতি রক্ষার বহমান স্রোত। প্রতিটি শিশুর অন্তরেই অনন্ত সম্ভাবনায় অন্তর্নিহিত রয়েছে জাতীয় নেতৃত্ব। তাদের যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে শিক্ষাদীক্ষা, কাজ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তৈরি করে যথোপযুক্ত বিকাশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়, তবে তারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে তারা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে। কাজেই শিশুরা শারীরিক-মানসিকভাবে যত উন্নত হবে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ তত সমৃদ্ধ হবে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি ততটা উন্নত নয়। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বেঁচে থাকা অসংখ্য শিশু শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেক ক্ষেত্রে অভাবের তাড়নায় অভিভাবকরা তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা নিজেরাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে তারা। শিশুদের এ অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য আইন, সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সনদ ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে পরিপূর্ণ সুফল মিলছে না। অথচ বিশ্বজুড়ে শিশুর অধিকার অধিকার রক্ষায় আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
শিশু সুরক্ষা বলতে শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন, শোষণ, অবহেলা এবং ক্ষতিকর প্রথা থেকে রক্ষা করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ এবং নীতিমালা বোঝানো হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। শিশু সুরক্ষার আওতায়, শিশুদের মৌলিক অধিকার রক্ষা, নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এ লক্ষ্যেই ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয়। যা শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে কাজ করে। শিশু অধিকার সনদে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। বেঁচে থাকা ও উন্নয়নের অধিকার, মতামত প্রদানের অধিকার, বৈষম্যহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ দেখা। শিশুদের যেকোন ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। এই সনদটি বিশ্বব্যাপী প্রায় প্রতিটি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা শিশুদের সুরক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করে। অন্যদিকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। যা শিশুদের অধিকার এবং সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ কাঠামো প্রদান করে। পাশাপাশি সুরক্ষার মাধ্যমে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত এবং সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত পালন হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ। এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রতিটি শিশুর অধিকার, রক্ষা আমাদের অঙ্গীকার’। কিন্তু বাস্তবে অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
এটা সত্যি যে, শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এরপরও শিশুর অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি অপরাধ চক্রের সদস্যরা শিশুদের নানা অপরাধকর্মে লিপ্ত হতে উৎসাহ যোগায়। আরেকটি চক্র রয়েছে যারা ছিন্নমূল কিংবা দরিদ্র শিশুদের বলপূর্বক বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করে। এর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে এসব শিশু। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অধিকার বঞ্চিত শিশুরা শিশু আইনের সুফল না পাওয়ায় এসব অপরাধীরা অনায়াসেই পার পেয়ে যাচ্ছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করেছে, কিন্তু তার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও মাদককে চিরতরে বিতাড়িত করতে হবে। যৌন হয়রানি ও অশিক্ষাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অভিভাবকের সচেতনতা শিশু অধিকার রক্ষার পূর্বশর্ত। শিশুর অধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি বড় কারণ বাল্য বিবাহ। একটি জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। যদিও এই হার অনেকটা কমতে শুরু করেছে। তবে এটি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে কোনো সমন্বিত ব্যবস্থা নেই।
শিশুদের প্রতি সহিংসতা, দুর্ব্যবহার, অবহেলা ও শোষণ রোধে এবং এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাড়া প্রদান করতে একটি সমন্বিত জাতীয় শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও শিশুদের অধিকার রক্ষায় তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এসব তৎপরতায় শতভাগ সুফল মিলবে না। সর্বোপরি পরিবার এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হতে হবে। ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’- এ স্লোগানকে সামনে রেখে শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। দেশের সব শিশুকে সমানভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের সামনে যেসব প্রতিবন্ধকতা আসবে তা আমাদেরকে দূর করতে হবে। তাদেরকে সুন্দর ও সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুরা ছোটকাল থেকে সুন্দর ও সুস্থ সামাজিক পরিবেশে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারলে তার ভবিষ্যৎ জীবন হবে সম্ভাবনাময়। আর তাদের সুষ্ঠভাবে বেড়ে ওঠার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব নিতে হবে তাদের অভিভাবকদের। কোনো শিশুই যেন বিপথগামী না হয় সেই খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি দেশে বিরাজমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে শিশুর বিকাশ বহু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে সবাইকে হতে হবে সংবেদনশীল। শিশুর গর্ভকালীন পরিচর্যা, অসুস্থতা, অপুষ্টি, শারীরিক ত্রুটি, দুর্ঘটনা, অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত সতর্ক থাকতে হবে প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে। দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার রক্ষায় সবাইকে যত্নবান হতে হবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে সুর মিলিয়ে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে শপথ নিতে হবে, ‘তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। -পিআইডি ফিচার
Related News

জিলক্বদ মাসের ফজিলত ও ইবাদত
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী: জিলকদ হলো আরবি চান্দ্রবছরের একাদশ মাস। এটি হজের তিন মাসের (শাওয়াল,Read More

সিলেটে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতিবৃত্ত
আতিকুর রহমান নগরী: সময়টা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিক। সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠেরRead More
Comments are Closed