Main Menu

আর কত স্বপ্ন ঝরলে জাগবে আমাদের বিবেক

শাহ মনসুর আলী নোমান: যানবাহন চালকদের বেপরোয়া আচরণের ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।

অনেকেই আহত এবং অঙ্গহানি হয়ে খুবই করুন এবং বিয়োগান্তক জীবন যাপন কাটাচ্ছেন। সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত স্বজনদের আর্ত -চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না।স্বজন হারানোর বেদনায় মানুষের আহাজারি আর কতদিন চলতে থাকবে।যে মানুষটি ছিল পরিবারের অন্যতম অবলম্বন ও মধ্যমনি,অপ্রত্যাশিত সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু সেই পরিবারের সদস্যদের সব আশা – আকাঙ্ক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে তোলে।তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।এই অনিশ্চিত যাত্রা যেন আমাদের দেশের নিত্য -নৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহের অংশ।বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বহুমুখী বিরূপ প্রভাব বিদ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানমতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষেত্রে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং সারা বিশ্বের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা খুবই উদ্বেগজনক । সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে।দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে নি:স্ব-অসহায় হয়ে পরে।ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে এবং বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ছোট বড় রাস্তা,সড়ক- মহাসড়কে চলাফেরা করার সময় পথচারীরা অগ্রাধিকার পায়।সেখানে যানবাহন চালকরা পায়ে হেঁটে চলা পথচারীদের সকল সুযোগ -সুবিধা বিবেচনায় রেখেই যানবাহন পরিচালনা করে। রাস্তার পাশে মানুষের সমাগম, পথচারী রাস্তা পারাপারের সময় এবং সড়কে লোকজন অতিক্রম করতে দেখার সাথে সাথে চালকরা সতর্ক হয়ে যায়।ব্যস্ত রাস্তাতেও পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের দিকে চালকরা অধিক মনোযোগী থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে সব জায়গাতেই এর বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে। বাংলাদেশের যানবাহন চালকদের বেপরোয়া আচরণ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়াতে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কর্মী আব্দুল্লাহ সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী কিছুদিন ছাত্ররা সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে সড়ক নিরাপত্তা রাখার কাজ করেছে, তখন পরিস্থিতি ভালো ছিল,এখন আবার পূর্বের মতো বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে সড়ক, যা আমাদের হতাশ করে।”

সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে।যদিও বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ৭/৮ হাজার।নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে ছাত্ররা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলনে নামে। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ কিছুটা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বর্তমানে সড়কে সেই পুরনো দুরবস্থাই ফিরে এসেছে।বাস চালকদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে দেশে অকালে ঝরে গেছে অনেক তরতাজা প্রাণ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন মহল সোচ্চার হলেও অদ্যবধি কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাত্রী ও পথচারীরা।

২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সড়কে প্রাণহানি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা ছিল সবার।বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোন উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমের সহিত এক সাক্ষাৎকারে সড়কে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং নিরাপদ সড়ক রাখার বিষয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। সড়কপথে অপরিকল্পিত স্পিড ব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, সহকারী বা হেল্পার দিয়ে গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে ওভারটেক করা, সড়ক-মহাসড়ক এবং রাস্তার পাশে হাট-বাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব, ট্রাফিক আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল, পথচারীদের অসচেতনতা ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। ইদানীং সড়কে হেলমেটবিহীন এবং দ্রুত গতিতে মোটরবাইক চালানোর কারণে আশঙ্কাজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সড়কের বিশৃঙ্খলা,ড্রাইভারদের মধ্যে অসুস্থ ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যান চলাচল করে। বিশেষ করে বর্তমানে দুই ও তিন চাকার গাড়ির আধিক্যে দুর্ঘটনা আরও বেড়েছে। দুর্ঘটনায় দায়ী ড্রাইভাররা যেন সহজেই ছাড়া পেয়ে যেতে না পারে,রাস্তার ত্রুটি দূর করে ট্রাফিক আইন মেনে রাস্তায় পথচারী চলাচল, রাস্তায় সঠিকভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করা, ড্রাইভারদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, তাদের পরিমাণ মতো বিশ্রামের ব্যবস্থা করা,সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ প্রয়োগ, যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা, হেলমেট ব্যবহার করা, সামাজিক সচেতনতা ও সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সড়ক নিরাপদ হবে।তাসনিম জাহান আইরিন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করতেন। অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তা পারাপারের সময় রাজধানীর মধ্য বাড্ডার প্রগতি সরণীতে দুটি বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে প্রাণ হারান আইরিন। তার মৃত্যু আমাদের সড়ক ব্যবস্থার পুরানো সেই দুরবস্থার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন থেকেই দেশে বাস চালকদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে যাত্রী সাধারণ ও পথচারীরা প্রাণ দিচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। আর কতকাল দেখব সড়কে এরকম লাশের মিছিল।তাসনিম জাহান আইরিন এর মত প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় পারিবারিকভাবে আইরিনের বিবাহের কথাবার্তা চলছিল। তারও স্বপ্ন ছিল সুন্দরভাবে এ পৃথিবীতে বাঁচার। কিন্তু অনিরাপদ সড়ক কেড়ে নিল তার প্রাণ।সড়কে আর কত প্রাণ ঝরবে,আর কত স্বপ্ন ঝরলে জাগবে আমাদের বিবেক?এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক: কলামলেখক, গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসক। সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

Share





Comments are Closed