Main Menu

ইরান থেকে তুরস্কে যাওয়ার পথে নিখোঁজ নবীগঞ্জের দুই যুবক

নবীগঞ্জ সংবাদদাতা: ইউরোপে পাড়ি দিতে উঁচু-নিচু পাহাড়, মরুভূমি আর বরফে ঢাকা দুর্গম বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে ইরান থেকে তুরস্ক সীমান্ত পারাপার হওয়ার সময় নিখোঁজ হয়েছে মাসুদ ও পাবেল নামে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দুই যুবক।

মাসুদ ৬ মাস ও পাবেল ৩ মাস ধরে নিখোঁজ। বেঁচে আছে না কি মারা গেছে তাও জানেনা পরিবার। নিখোঁজ হওয়া একই গ্রামের দুই যুবকের পরিবারে চলছে কান্নাররোল। দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দুবাই থেকে জাহাজে ইরান পৌঁছান নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের সাতাইহাল গ্রামের দলাই মিয়ার ছেলে মাসুদ রানা (২১)। চার ভাই ১ বোনের মধ্যে মাসুদ ছিল সবার বড়। মাসুদ দেশে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারী পাহাড়ি পথ বেয়ে ইরান হতে তুরস্ক প্রবেশের চেষ্টা করে। তুরস্কে অবস্থানরত দালাল সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার জুয়েল মিয়ার মাধ্যমে ইরান-তুরস্ক যাওয়ার গেইমে ওঠে মাসুদ। এই গেইমে বাংলাদেশী ৮-১০জনসহ ২৪জন যুবক ছিল। উঁচু-নিচু পাহাড়, মরুভূমি আর বরফে ঢাকা দুর্গম বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে তুরস্ক সীমান্ত অতিক্রম হওয়ার সময় গেইমের সামনে থাকা মাসুদ ও আফগানিস্তানের ৩ যুবক সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়। অপর ২০ জন পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ইরান ফিরে আসে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত দালাল জুয়েলের সঙ্গে মাসুদের পরিবার যোগাযোগ করলেও ৬ মাসেও মাসুদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

মাসুদের মা সাজনা বেগম জানান, ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে আমার ছেলে রওয়ানা হওয়ার আগে বলেছিলো ‘আম্মাগো আমার জন্য দোয়া করিও পৌঁছে ফোন দিবো। ৬ মাস হলেও ছেলেতো আর ফোন করে না, আল্লাগো আমারের ছেলেরে ফিরাইয়া দেও’ তিনি বার বার ছেলের স্মৃতি মনে করে মুর্ছা যাচ্ছিলেন।

এদিকে একই কায়দায় দালালদের খপ্পড়ে পড়ে ইরান থেকে তুরস্ক যাওয়ার পথে নিখোঁজ সাতাইহাল গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য চুনু মিয়ার ছেলে শাহ পাবেল আহমেদ। তার পরিবার পরিবার জানায়, গত ১২ এপ্রিল ছাত্রলীগ নেতা শাহ পাবেল আহমদসহ ৩৫ জন যুবক ইরান থেকে তুরস্ক পথে যাত্রা শুরু করে। তুরস্ক সীমান্ত অতিক্রম করার সময় দালাল চক্রের সদস্যরা রাতের অন্ধকারে পাহাড়-পর্বত মরুভ‚মি আর বরফে ঢাকা দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে তুরস্কে প্রবেশকালে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায়। এ সময় ৮জন যুবক একদিকে লুকিয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে ২৭জন যুবকের সঙ্গে পাবেল দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এরপর থেকে পাবেল নিখোঁজ হয়। ৩ মাস হলেও পাবেলের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ পাবেলের মামা সাইফুর রহমান তালুকদার জানান, শাহ পাবেল আহমদ (২৩) দেশের বাহিরে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে তার ছোট ভাই শাহ ফাহিম ও তার মা নাজমা তালুকদার মারা যান। নিজের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করতে বার বার নিষেধ করা পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেটে ইউরোপ যাওয়ার চিন্তা করে। কিন্তু তার ছোট বোন ও ভাইকে মানুষ করার আগেই সে হারিয়ে গেলো। ৪ ভাই বোনের মধ্যে পাবেল ছিলো সবার বড়।

তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘পাবেলের মা মারা যাওয়ার পর আমাদের কাছেই সে বড় হয়েছে, মা হারা পাবেলকে অনেক কষ্ট করে লালন-পালন করেছি। ইরান অবস্থানকালে ও তুরস্ক যাওয়ার গেইমে উঠার পূর্বে আমার সঙ্গে আমার ভাগিনার কথা হয়েছে। সে দেয়া চেয়ে বলেছিল মামা আমি পৌঁছে ফোন দিব, কিন্তু আর তাকে ফোনে পাইনি। তার সঙ্গে গেইমে থাকা সঙ্গীদের তথ্য অনুযায়ী পুলিশ তাদের দেখে অভিযান চালালে যে যার মতো দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এরপর থেকে পাবেলের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন- দালালরে ফোন দেই দরে না তিন মাস হয়ে গেল পাবেলের মাত হুনছিনা সরকারে যদি অকন আমার ভাগিনারের বাচাইয়া দেয় সরকারের কাছে ভিক্ষা চাই।’ নিখোঁজ পরিবারের লোকজনের দাবি দালাল চক্রের সদস্যদের কঠোর শাস্তি দিলে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া কমবে।

মৃত্যু ঝুঁকির পথ বেয়ে ইরান-তুরস্ক সীমান্ত নিয়ে আল-আমিন আহমেদ নামে পাবেলের এক সহপাঠী জানান, আমি বর্তমানে ইরানে আছি, পাবেলের সঙ্গে একই গেইমে তুরষ্ক যাওয়ার কথা ছিল, গেইমের একদিন আগে আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি। ইরান হতে তুরস্ক সীমান্ত অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, সীমান্তপথ পাড়ি দেয়া বর্তমানে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, অনেক উঁচু-নিচু পাহাড় অতিক্রম করতে হয়, পাশাপাশি মরুভ‚মি আর বরফে ঢাকা দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। ইরান-তুরস্ক গেইমের সামনে ও পেছনে দালাল চক্রের সদস্যরা থাকেন। রাতের অন্ধকারে কোনো ধরনের আলো ছাড়াই দালাল চক্রের সদস্যদের পিছনে-পিছনে যেতে হয়। কখনো দীর্ঘপথ মরুভূমি, আবার কোনো কোনো সময় উঁচু-নিচু পাহাড় কিংবা বরফে ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ পথ।পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়। একটা সময় মানুষ অহরহর ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছে। তবে বর্তমানে সীমান্তে কঠোর অবস্থানে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা।তাদের হাতে আটক হলে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।আমি ৩-৪ বার গেইমে উঠেছি কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়েছি।

আফিল উদ্দিন নামে এক দালাল জানান. আমি একটা সময় ইরান থেকে তুরস্ক মানুষ পাঠাতাম, তখন ৯৯% গেইম সাকসেস হত, বর্তমানে ঝুঁকি শতভাগ বেড়ে গেছে এ জন্য এখন আর মানুষ পাঠাইনা। তিনি ইরান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্ক না যেতে সবার প্রতি আহবান জানান।

Share





Related News

Comments are Closed