Main Menu

জৈন্তাপুরের শ্রীপুর ফিরে পেয়েছে হারানো যৌবন

মো. রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর প্রতিনিধি: ধুলো, শব্দ আর ধ্বংসলীলা। পাথর খেকোদের ক্ষত-বিক্ষত আঁচড়। এসবের কারণে প্রায় বিলীন হতে বসেছিল নদী, পাহাড় ও চা-পাতাবেষ্টিত পর্যটন ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র শ্রীপুর। একসময় ঢাকাই সিনেমার অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চিত্র ধারণ হতো এই শ্রীপুরে। সেই পর্যটন কেন্দ্রটির সোনালী দিন গুলো স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছিল। অবশেষে ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরছে শ্রীপুর। পরিবেশ, প্রকৃতিপ্রেমী ও পর্যটকদের দাবি, গত ৫-৭ বছর পাথর কোয়ারী বন্ধ রাখার কারনে শ্রীপুর পর্যটন কেন্দ্রটি তার অতীত ফিরে এসেছে।

তবে পাথর খেকুদের থাবা, স্থানীয় প্রশাসনের চরম অবহেলা ও উদাসীনতায় শ্রীপুরের ফিরে আসা শ্রী পুনরায় বিলিন হতে শুরু হয়েছে। পর্যটন প্রেমীদের দাবী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে শ্রীপুরের সৌন্দর্য্য মুছে ফেলবে পাথর খেকুরা।

সরেজমিনে উপজেলার শ্রীপুর এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সিলেটের পর্যটন স্পট এর মধ্যে অন্যতম স্থান ছিল শ্রীপুর। নদী, পাহাড়, অরণ্যবেষ্টিত এবং মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা রংহংকং নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে শ্রীপুর বা রাংপানি নদী হিসেবে নাম ধারণ করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের বহু ছবির নির্মাণ করা হয়েছে শ্রীপুরে। জৈন্তাপুর উপজেলার নাম নিলে সবার আগে শ্রীপুর পর্যটন স্পটই দৃশ্যপটে হাজির হতো। সময়ের ব্যবধানে তা বিলিন হয়ে যায়।

সূত্র জানায়, ২০০০ সালের শুরুর দিকে উপজেলার শ্রীপুর পর্যটন কেন্দ্র থেকে পাথর আহরণ শুরু করে একটি পাথরখেকো মহল। সরকারও রাজস্ব আদায়ের জন্য শ্রীপুর/রাংপানি নদীটি ইজারা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় শ্রীপুর পাথর কোয়ারীর জন্ম হলে কিছু দিনের মধ্যে শ্রীপুর পর্যটন স্পটটি বিলিন হয়ে যায়। এভাবেই জৈন্তাপুর উপজেলার অন্যতম সৌন্দর্য্যরে পর্যটন কেন্দ্রটি নিয়ে ক্রমশ পর্যটকদের ভাললাগা কমতে থাকে। একপর্যায়ে হারিয়ে যায় শ্রীপুরের গৌরবগাঁথা ইতিহাস।

২০১৮ সালের শেষ দিকে শ্রীপুর পাথর কোয়ারীকে সংকটাপন্ন ঘোষণার দাবি জানায় বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। এসব দাবির প্রেক্ষিতে দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীপুর নদীর সরকারি অংশের তলদেশে ত্রি-মাত্রিক জরিপ পরিচালনা করে। সংস্থা গুলো সেখানে পাথরের মজুদ নেই মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ লিজ প্রথা বাতিল করে। তারই ধারাবাহিকতায় উপজেলার শ্রীপুর পর্যটন কেন্দ্রটি প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সাজিয়ে তুলে নতুন রূপে।

নামপ্রকাশে স্থানীয় বাসিন্ধারা বলেন, পর্যটক বিমুখ করতে একটি ১০ হতে ১২ সদস্যের পাথর খেকু চক্র গত বছরের (২০২২) সেপ্টেম্বর মাস হতে বর্তমান পর্যন্ত শ্রীপুর কোয়ারীর জিরো লাইন হতে পাথর আহরণ করছে। ইতোমধ্যে চক্রটি প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের পাথর লুট করেছে। প্রশাসনের অভিযান নিয়ে তাদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব অভিযান শুধুমাত্র লোক দেখানো অভিযান। তাদের দাবী প্রশাসনের চরম উদাসীনতা ও অবহেলার কারনে এই পর্যটন কেন্দ্রটি হতে পাথর খেকু চক্রের সদস্যরা পাথর লুট করছে।

তারা আরও বলেন, সরকারী ভাবে কোয়ারী বন্দ রয়েছে প্রায় ৬ হতে সাত বৎসর ধরে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোয়ারীটি কখনো বন্দ ছিল না। কোয়ারীর জিরো লাইন হতে ১৫০ হতে ২শত শ্রমিক নিয়োগ করে পাথর লুন্টন হচ্ছে। ফলে অতি তাড়াতাড়ি আঙ্গল ফুলো কলাগাছে পরিনত হচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে ১০ হতে ১২জন ব্যক্তি। তারা অর্থের জন্য দেড় শতাধিক শ্রমিককে সীমান্ত অতিক্রম করে জীবন ঝুঁকির মধ্যে রেখে পাথর আহরন করাচ্ছেন। তাদের দাবী তুলে বলেন, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য শ্রীপুর কোয়ারী খুলে দেওয়া হউক নতুবা শ্রীপুরকে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনা করা হউক। তারা আরও বলেন প্রশাসন চাইলে একটি বালুও নড়বে না। এজন্য সিলেটের জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, সিলেটের ডিআইজি, সিলেটের পুলিশ সুপার, সিলেটের পরিবেশ অধিদপ্তর সহ ৪৮ বিজিবির কমান্ডিং অফিসারগণের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

সিলেট শহরের বাসিন্দা রাজিব রায় বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন শ্রীপুরে। তিনি বলেন, একসময় আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শ্রীপুরের দৃশ্য দেখেছি। এখানে বেড়াতে এসে দেখলাম প্রকৃতি আপন মহিমায় শ্রীপুরকে সাজিয়ে রেখেছে। সত্য কথা হল শ্রীপুর ঘুরতে না আসলে রূপের মহিমাটি কখনও দেখা হতো না। এ পর্যটন কেন্দ্রটিকে সংরক্ষণ করা হলে অসাধারণ পর্যটন স্পট হয়ে উঠবে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।
সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়া এটাকে রাংপানি বলে উল্লেখ করলেও প্রকৃত পক্ষে এটি হবে শ্রীপুর।

জৈন্তাপুর ইমরান আহমদ মহিলা ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, শ্রীপুর একসময় ছিল উপজেলার জনবহুল স্থানের একটি। কালের বিবর্তনে পরিবর্তন আসে। সম্প্রতি কোয়াারী বন্ধ থাকায় প্রকৃতি নতুন রূপে সাজিয়ে তুলছে তার ক্ষত স্থানকে। সৌন্দর্য্য ছাড়িয়ে দিচ্ছে ভ্রমণ পিপাসুদের মধ্যে। শ্রীপুররের পাথর উত্তোলন ৪ হতে ৫ বছর বন্ধ রাখা হলে বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বেষ্টিত নিরিবিলি সেরা আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত হবে শ্রীপুর বা রাংপানি।

সারী নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, শ্রীপুরের বর্তমান যে চিত্র সরজমিনে দেখা মিলেছে তা অভাবনীয়। শ্রীপুরের এখন যে রূপটি ফুটে উঠেছে তাকে ধরে রাখতে হবে। প্রকৃতিকে ধরে না রাখতে পারলে অচিরেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হব আমরা। উত্তরপুর্ব সিলেটের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে জৈন্তাপুর লাল তালিকায় চিহ্নিত হয়েছে। সেজন্য প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ না করে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতি নির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

 

Share





Related News

Comments are Closed