রবিউল আউয়াল মাসের পয়গাম
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: ইসলামি ইতিহাসে রবিউল আওয়াল গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি মাস। ঐতিহাসিক মাস। হিজরি সনের চাকা ঘুরে আবার আমাদের মাঝে উপস্থিত এখন এ মাসটি।
রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ আকাশে উঁকি দিতেই বিশ্বময় মুসলমানদের মাঝে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহাব্বত নতুন করে জাগ্রত হয়। কারণ, অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন খাতামুন নাবীয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন এ মাসে, আবার এ মাসেই তিনি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত রিসালাতের সকল দায়িত্ব পালন শেষে স্বীয় প্রভুর আহবানে সাড়া দিয়ে পরলোক গমন করেন।
যখনই এ মাসের শুভগমন হয়, মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে নবী-প্রেমের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুন করে আন্দোলিত হয়। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মাঝে অনেক মতভেদ রয়েছে, যথাক্রমে : ১২, ৯, ৮ রবিউল আউয়াল। কিন্তু এ মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছেন, এ বিষয়ে কোনো মতানৈক্য নেই। (আস্ সীরাতুন্ নববিয়া লিমুহাম্মদ ইবনে ইসহাক্ব : ১৫৯,আল্লামা ইদ্রিস কান্দলভী : সীরাতে মুস্তাফা খন্ড : ১)।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা ও তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (রহ.) তার কিতাবে স্বতন্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন, যার অর্থ ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ’। বিশিষ্ট সাহাবী আনাস (রা.) ও আবূহুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হবো’। (বুখারী শরীফ : হা: ১৫, মুসলিম শরিফ: হা: ৪৫, মুসনাদে আহমদ: ১২৪৩)।
কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবী! আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমদের সন্তান, তোমাদের ভাই-বোন, তোমদের পতিœ, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর- আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসেক স¤প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সূরা তাওবা : ২৪)।
উল্লিখিত আয়াতে গোটা মুসলিম জাতির প্রতি এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারো ভালবাসা স্থান পাবে না। তাই যার ভালবাসা এ স্তরে নেই সে শাস্তির যোগ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসার অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত আলোচনা করা যেমন পূণ্যের কাজ তেমনিভাবে তার সূরত বা দৈহিক গঠন নিয়ে আলোচনা করাও পূণ্যের কাজ। কিন্তু দৈহিক সূরত নিয়ে আলোচনার মাঝে আমাদের করণীয় কিছু নেই। শুধু আলোচনার দ্বারা সাওয়াব পাওয়া যায়। কারণ শত চেষ্টা করেও আমাদের সূরতকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সূরতের ন্যায় করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে তাঁর (সা.) সীরাত নিয়ে আলোচনার দ্বারা সাওয়াব পাওয়াব পাশাপাশি অনুরুপ চরিত্র গঠনের আশা করা যায়, যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি।
অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের মুসলিম সমাজের কতিপয় লোক ভালবাসার নামে রাসূলের জীবনাদর্শ ও সুন্নাতকে বাদ দিয়ে রবিউল আউয়াল মাস এলে ঈদে মীলাদুন্নবী ও জসনে জুলুসের নামে নারী পুরুষ সম্মিলিত বর্ণাঢ্য র্যালি, আনন্দ মিছিল ও শোভ যাত্রার মধ্য দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিনকে শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করাকে ইবাদত মনে করেন। বস্তুত এসব কার্যাবলী অমুলক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যার কোনো শরয়ি ভিত্তি নেই। একটু চিন্তু করলে দেখা যায়, রবিউল আওয়াল মাসের এ দিনটিতে রাসূলের জন্মের ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে, কিন্তু এ দিনটিতে তার ইন্তেকালের ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। তাহলে আমরা এ দিনটিতে আনন্দ উৎসব পালন করি কিসের ভিত্তিতে?
বরং সত্যিকারার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসার অর্থ হলো, তিনি যে সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যে সকল বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর’। (আল হাশর : ৭)।
রাসূলের (সা.) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’। (আল আহযাব : ২১)।
কোরআন ও হাদিসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে আমল করেছেন বা করতে বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেয়ার নামই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করাকে শরিয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসার ব্যাপারে তিনি যেভাবে ভালবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে ভালবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালবাসাই হলো ইবাদত। এতে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করা শরিয়ত সমর্থন করে না। পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপার নিষেধও করেছেন। তিনি বলেছেন, খ্রীষ্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারিয়ামের (আ.) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব, তোমরা বল আল্লাহর বান্দ এবং তাঁর রাসূল।
এখানে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যাবলীর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করা। যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির-নাজির বলা, তিনি নূরের তৈরি, তিনি গায়েব জানেন, তার নামে কসম খাওয়া, তাঁর নামে মান্নত করা, তাঁর নিকট দোয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা আল্লাহর গুণ সমূহে গুণান্বিত করা ইত্যাদি । এ ধরনের কার্যকলাপ শরীয়তে গর্হিত। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।
ঈদে মীলাদুন্নবীর গোড়ার কথা:
ইরাকের মসল শহরে অত্যাচারী শাসক মজাফফর উদ্দীন কাওকারীর শাসনামলে ৬০৪ হি: সনে ধর্মপ্রিয় জনসাধারণের জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে দুনিয়াদার দরবারী আলেম আবুল খাত্তাব দিহয়ার মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ মিলাদের প্রচলন শুরু হয়। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়াতের ২৩ বছর, খোলাফায়ে রাশেদার ৩০ বছর, পরবর্তী সাহাবিদের ১১০ হিজরী সন, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও মুজতাহিদ ইমামগণের ৬০০ হিজরী সন পর্যন্ত ঈদে মিলাদুন্নবীর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বুঝতে হবে প্রচলিত অনুষ্ঠানাদি শরিয়ত সম্মত নয়। পক্ষান্তরে সাহাবায়ে কেরামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালবাসা ছিল নজীর বিহীন। যারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে রাসূলের থুথু হাতে মুখে মেখেছিলেন এবং উহুদ প্রান্তরে তালহা (রা.) নিজেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তাতে তার দেহে ৭০টি তীরের আঘাত লেগেছিল। এ ছাড়াও সাহাবায়ে কেরামের নবী প্রেমের অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। তারা কোনো দিন এ ধরণের বাহ্যিক সাজ-সজ্জা, আড়ম্বরতা, মুখরোচক শ্লোগান ও লৌকিকতাপূর্ণ মাসিক বা বাৎসরিক প্রথা হিসেবে কোনো অনুষ্ঠান পালন করেননি। বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা রাসূলের (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করেছেন। ভালবাসার ক্ষেত্রে তাদের মত সুন্নাতের অনুকরণ ও আদর্শে আদর্শবান হওয়া ইবাদত ও সাওয়াবের কাজ। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ঈমান আন যেমনি ঈমান এনেছেন মানুষগণ অর্থাৎ সাহাবাগণ’। (আল্ বাক্বারাহ : ১৩)।
সুতরাং তাদের ঈমান ও আমল অনুযায়ী আমাদের ঈমান ও আমল হওয়া বাঞ্জনীয়। তাদের ঈমান ও আমলের প্রতি আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দলের অন্তর্ভুক্ত। যেনেরেখ আল্লাহর দলই সফলকাম হবে’। (আল মহাদালাহ : ২২)।
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট।
Related News
ক্রান্তিকালে ফ্যাসিবাদের কথকতা
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস এবং তার স্ত্রী ইমেলদা অনেকটা শেখ হাসিনারRead More
মাঙ্কিপক্স: আতংকিত না হয়ে সতর্ক থাকুন
মাসুদ পারভেজ: চলতি বছর কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রথম মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স শনাক্ত হয়। গত জানুয়ারি থেকেRead More
Comments are Closed