Main Menu

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা

পিযুষ চক্রবর্তী: নারী মানেই মা, বোন আর কন্যা সন্তানের সমন্বিতরূপ যাদের ছাড়া হয় না পরিবার তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন কিছুর উন্নতি বা অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের তাৎপর্য হচ্ছে, পৃথিবীর নারীদের অধিকার কতটুকু অর্জিত হয়েছে এবং তার কী কী বৈষম্য ও বাধার সম্মুখীন তা মূল্যায়ন করা ও পৃথিবীর নারীসমাজের কাছে তুলে ধরা। নারী অধিকার অর্জনে জাতিসংঘের ভূমিকার দীর্ঘ ইতিহাসও আন্তার্জাতিক নারী দিবসের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। মানবজীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি, কল্যাণ এবং অধিকারের প্রশ্নে উদ্ভূত বিভিন্ন বিষয়ে সার্বজনীন চেতনার ভিত্তিতে পালিত হয় আন্তর্জাতিক দিবসগুলো। জাতিসংঘের জন্মলগ্ন থেকে মানব কল্যাণে গৃহীত কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ, তার অংগসংগঠন এবং বিশেষায়িত সংস্থাগুলোই অধিকাংশ আন্তর্জাতিক দিবসের ঘোষণাকারী। আন্তর্জাতিক দিবসের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব যেমনই হোক, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ টির অধিক আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়। এসব দিবস পালনের সাধারণ কর্মসূচির মধ্যে থাকে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বাণী প্রচার, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, র‌্যালি, সেমিনার/ওয়ার্কশপ/আলোচনা সভা আয়োজন, মেলা/প্রদর্শনী, পোস্টার/লিফলেট/স্টিকার বিতরণ ইত্যাদি।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সুচ কারখানায় মহিলা শ্রমিকরা কারখানার মানবেতর পরিবেশ, অসম মজুরি ও ১২ ঘন্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সেদিন তারা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু পুলিশ নিরীহ শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং অনেককে বন্দী করে। পুলিশি অত্যাচারের দিনটি স্মরণ রেখে নিউইয়র্কের সূচ কারখানায় মহিলা শ্রমিকগণ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চ একত্রিত হয়ে মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে। মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন এগিয়ে চলে। তাদের আন্দোলন কারখানা ও ইউনিয়নের সীমা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ। ওই বছর ৮ মার্চ ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে জার্মানের মহিলা নেত্রী ব্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের ঘোষণা দেন।

বিশে^র নারী সমাজ ৮ মার্চ পালন করতে থাকে। ৮ মার্চের সূচনা নিউইয়র্কে হলেও এ দিবসটি ইউরোপে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। দিনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বছরের একটি দিনে নিজ নিজ দেশের ঐতিহাসিক, জাতীয় ঐতিহ্য ও প্রথার আলোকে মহিলাদের অধিকার ও বিশ^ শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ এই দিনটিকে দিবস হিসেবে পালনের জন্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রসমূহ মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক অবস্থা দূরীকরণ প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয় (সিদ্ধান্ত ৩২/১৪২)। জাতিসংঘের কর্মচারীগণ ৮ মার্চ তারিখে এ দিবসটি পালন করতো। পৃথিবীর অনেক দেশে ঐ তারিখে আন্তর্জাতিক মহিলা শ্রমিক দিবস পালিত হতো। যেহেতু নারী সমাজ শতাধিক বছর ধরে উদযাপন করে আসছিলো তাই তাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চ কে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঘোষণা করে। এ ঘোষণার ফলে বিশে^র হাজার বছর ধরে অধিকার বঞ্চিত নারীসমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়।

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘে এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কমিশন অব দ্য স্ট্যাটাস অফ উইমেন প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মহিলা সম্পকীয় বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। এ পরিষদের একটি কার্যনির্বাহী কমিশন হলো কমিশন অব দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন। এ কমিশন মহিলাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে মানবাধিকার ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় বলা হয়েছে, সকল মানুষ সমভাবে জন্মগ্রহণ করে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে ঘোষণায় উল্লিখিত অধিকারসমূহ ভোগ করার অধিকার আছে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কমিশন অব দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন মহিলাদের রাজনৈতিক অধিকার, ভোট প্রদানের অধিকার, দপ্তরে কাজ করার সম-অধিকারের কনভেনশন আহ্বান করে। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ এর কনভেনশনে মহিলাদের বিয়ে ও বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে জাতিসংঘ নারীদের মধ্যে সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি, কর্ম, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যাপারে সমান অধিকার প্রদানের উদ্যোগ নেয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ পরিষদ ১৯৭৫-কে বিশ্ব নারীবর্ষ ঘোষণা করে। বিশ্ব নারীবর্ষের উদ্দেশ্য ছিল নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা ও উন্নয়নে মহিলাদের সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করা ও বিশ্ব শান্তিতে মহিলাদের অবদান বৃদ্ধি করা। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন হতে ২ জুলাই পর্যন্ত মেক্সিকো শহরে জাতিসংঘের উদ্যোগে ১ম বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৬-৮৫-কে নারী দশক ঘোষণা করে। নারী দশকের লক্ষ্য ছিল সমতা উন্নয়ন ও শান্তি। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি শহরে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আয়োজন করে জাতীয় বিশ্ব নারী সম্মেলন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বেইজিং-এ আয়োজন করে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন।

বিশ্বের নারী সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের পল্লি অঞ্চলে তেমন অগ্রগতি হয়নি। অপর দিকে বৈষম্য, শোষণ, নারী ধর্ষণ, নারী অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌন নির্যাতন, নারী পাচার, নারী হত্যাসহ নানাবিধ নির্যাতনের কবল থেকে আজও নারীদের মুক্তি সম্ভব হয়নি। এরকম প্রতিকূল একটি পরিবেশের মধ্যেই প্রতিবছর পালিত হয় নারী দিবস, উদ্বুদ্ধ করা হয় নারীদের অধিকারের প্রতি বিশ্বসমাজকে।

নারীর ভাগ্য উন্নয়নের জন্য বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও সক্রিয়। এ জন্যে সরকারের রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। নারীদের কল্যাণে কাজ করছে স্বতন্ত্রভাবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর কার্যাবলি হচ্ছে মহিলা ও শিশু বিষয় সম্পর্কিত জাতীয় নীতি, উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, মহিলাদের আইন ও সমাজ অধিকারের বিষয়াদি, মহিলাদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি। জাতীয় সংসদে ৩০টি সংরক্ষিত আসন ছাড়াও মহিলারা পুরষের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে মহিলদের জন্য রয়েছে সংরক্ষিত আসন। চাকরিতে মহিলাদের জন্য রয়েছে বিশেষ একটা পদ্ধতি। দেশে নারী ক্ষমতায়ন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। নারীদের জন্য বিনিয়োগে বিশেষ ব্যবস্থা বিদ্যমান। তবুও বাংলাদেশের নারীসমাজ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে আছে। তাই বাংলাদেশে নারী দিবস পালন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

সাম্প্রতিককালে নারীরা পুরুষের সাথে তালেতাল মিলিয়ে কর্মক্ষেত্র, সংসারক্ষেত্র ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। নারীদের গৃহকর্ম ছাড়াও জাতীয় বিভিন্ন পেশায় নিজ উপার্জন তথা জাতীয় ভাবে ভূমিকা রাখছেন যেমন- নার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইন প্রয়োগ সংস্থা, গার্মেন্টেস কর্মী, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিদেশে অভিবাসির কাজ, তথ্য প্রযুক্তিগত কাজ ও নারী উদ্যোগতা সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় নারীদের রয়েছে যুগান্তরকারী ভূমিকা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় শতাব্দীকাল আগেই বলেছেন- বিশে^ যা কিছু মহান সৃষ্টির চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে স্থানীয়-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নারী সমাজের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন সকলের কাম্য ও প্রত্যাশা।

লেখকঃ কলামিষ্ট, কবি

Share





Related News

Comments are Closed