Main Menu

চিন্তার সুবাসে বিকশিত মানবতার ফুল

Manual5 Ad Code

শাহ মনসুর আলী নোমান: জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে নিজেকে ও বিশ্বকে জানতে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই।বই সভ্যতার সূতিকাগার,স্বপ্নের কারিগর এবংএকজন বিশ্বস্ত বন্ধু। বই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়,আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত ও সুবাসিত করে। একটি ভালো বই হচ্ছে মনের খোরাক এবং জ্ঞানের ভান্ডার।মহাগ্রন্থ আল কোরআন এর প্রথম নাজিলকৃত আয়াতের প্রথম শব্দ – ‘ইকরা’ বা পড়। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টি বান্দাদের পড়ার জন্য,জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন।আমাদের জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।মানুষের জাগতিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চ সোপানে উপনীত হওয়ার প্রধান উপকরণ হলো বই।শিক্ষার জন্য বই-ই আলোর পথের সহযাত্রী।বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় হবে,সেই মানুষ তত উন্নত চিত্ত ও বিত্তের অধিকারী হবে।

ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘একজন তরুণ বা তরুণী যখন একটি বই কিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন আমি তাদের চোখে-মুখে অসংখ্য শুকতারা ঝলমল করতে দেখি।’

বই আমাদের চিরন্তন বন্ধু, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রসিদ্ধ ভান্ডার। বই মানবজীবনকে যেমন মহৎ করে সঠিক গন্তব্যে চলতে সহযোগিতা করে তেমনি ইতিহাসের আলোকে পথ প্রদর্শন করে ভবিষ্যত সফলতার বীজ বুনতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আগামীর স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়। বই আমাদের উদার ও মানবিক হতে শিক্ষাদান করে। বই পড়া জীবনের শ্রেষ্ঠ অভ্যাসগুলির অন্যতম সুঅভ্যাস।একটি ভালো বই একজন শিক্ষকের মতো পাঠককে জ্ঞান দান করে।

পারস্যের বিখ্যাত কবি,দার্শনিক ও গণিতবিদ ওমর খৈয়াম লিখেছেন,
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সেতো অনন্ত যৌবনা।’

Manual3 Ad Code

আমরা বিশ্বের বিভিন্ন গুণী ও বরেণ্য মানুষের জীবনী পাঠ করলে জানতে পারি,তাঁদের প্রত্যেকের জীবনই বইয়ের সঙ্গে নিবিড় ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল।বিপ্লবী নেতা চে’গুয়েভারা সবসময় বন্দুকের সাথে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’ বইটি রাখতেন।জগৎখ্যাত আলেকজেন্ডার দিনের একটি বিশেষ সময় বই পড়াতে মনোনিবেশ দিতেন।নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যুদ্ধক্ষেত্রেও বই সাথে রাখতেন।তাঁর শয়নকক্ষের পাশে ছিল বিশাল সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। আমাদের এই সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সমস্ত মনীষী পন্ডিত ব্যক্তি, নেতৃত্ব দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, আলোকিত করেছেন তাঁদের সবাই নিজে প্রচুর পরিমাণে বই পড়েছেন এবং অন্যদেরকেও বই পড়তে উৎসাহিত করেছেন।শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়,‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ কষ্টের বোঝা তার অনেকখানি কমে যায়।’

গণমানুষের চিন্তা চেতনার ধরন,বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা,শিক্ষা,সংস্কৃতি,প্রগতি ও সম্প্রীতির এক উৎসব বইমেলা।বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বইমেলা। বই ক্রয় বিক্রয় ছাড়াও এই মেলায় পারস্পরিক শিক্ষা,ঐতিহ্য,বিনোদনের আদান -প্রদান ও সেতুবন্ধন ঘটে। লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের জনগণ, পাঠক ও সাধারণ মানুষের উৎসব আনন্দ আর মহামিলন মেলায় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে বইমেলায়। বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, জ্ঞানের মেলা।বইমেলা আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।অমর একুশে বইমেলা আমাদের ইতিহাস,ঐতিহ্য ও জীবনধারাকে সামনে এগিয়ে নিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ও অনুপ্রেরণা যোগায় বইমেলা।

মুক্তধারা প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মহান ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি চত্বরে চাটাই বিছিয়ে ৩২ টি বই নিয়ে এই মহান মেলার শুভ সূচনা করেন।বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা পরিচালনা করে আসছে এবং ২০২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা। বইমেলাতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, লেখক -পাঠকদের অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকার এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপকতা এবং হাজার বছরের সম্মৃদ্ধির ইতিহাস বিশ্ববাসী অবগত হন।

Manual8 Ad Code

দেশের বইপ্রেমী মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন অমর একুশের বইমেলার জন্য।এখানে সর্ব শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণে বইমেলা একটি মহাউৎসবে পরিণত হয়। মেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার, লেখক -পাঠকদের অংশগ্রহণ ও সাক্ষাৎকার এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপকতা এবং হাজার বছরের সম্মৃদ্ধির ইতিহাস বিশ্ববাসী অবগত হন। একুশের বইমেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন পাঠক ও লেখক সৃষ্টি এবং বই পড়ার প্রতি দেশের সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই এই ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়।

Manual4 Ad Code

মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর পঞ্চদশ শতকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্বের প্রথম বইমেলার সূচনা হয় এবং ইহা ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।আবার অনেকে জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলার সূচনা হয়েছিল বলে অভিমত পোষণ করেন।১৭ শতকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে বইমেলা জনপ্রিয়তা লাভ করে।বুক এক্সপো আমেরিকা,লন্ডন বুক ফেয়ার, কলকাতা বইমেলা, নয়া দিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা ইত্যাদি বইমেলা আন্তর্জাতিকভাবে খুবই পরিচিতি লাভ করেছে।বাংলাদেশের বইমেলার সূচনার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক কথা সাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দিন ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে শিশু কিশোরদের জন্য তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরীতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী) একটি বইমেলার আয়োজন করেন।এটাই বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা।সরদার জয়েনউদ্দিন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জে আরো একটি বইমেলার আয়োজন করেন,সেখানে বই মেলার পাশাপাশি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন শহীদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মু্‌হাম্মদ আব্দুল হাই ও সরদার ফজলুল করিম।

বই জ্ঞান ও আনন্দের প্রতীক।বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি,পাঠকের সাথে লেখকের দেখা -সাক্ষাৎ ও মিলন মেলা,পারস্পরিক যোগাযোগ ইত্যাদি কারণে আমাদের জীবনে বইমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বইমেলায় লেখক-পাঠকদের মহামিলন হয়, জ্ঞানের বিস্তার ঘটে;মানুষ লেখক,কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখে।অনেকেই বইমেলা থেকে বই কিনে ও পড়ে মনীষী হিসেবে সুনাম অর্জন করে। বইমেলা থেকেই জ্ঞানের আলো, প্রীতি সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা, সামাজিকতা, উদারতা, নৈতিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই বইমেলা হচ্ছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মেলা।মানুষের অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার চিরন্তন আগ্রহ বই পড়েই মেটানো সম্ভব। একটি ভালো বই আমাদের মনের খোরাক এবং মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলে।

বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করে থাকেন। সেখানে লেখক পাঠক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সর্বশ্রেণীর মানুষের সমাগম ঘটে। বিশ্বের যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করছেন সেখানেই ছোট-বড় পরিসরে বইমেলার আয়োজন করা হয়।

যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস বেশ পুরনো।এখানে প্রায় ৮ লক্ষাধিক বাংলা ভাষাভাষি মানুষের বসবাস।যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী অভিবাসীরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস -ঐতিহ্য,বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং এই প্রজন্মের কাছে বই পড়ার গুরুত্ব তুলে ধরতে সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্য এর আয়োজনে ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর’ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে দু’দিন ব্যাপি বাংলাদেশ বইমেলার আয়োজন করা হয়।এটি ছিল বাংলাদেশ বইমেলার ১৩ তম আয়োজন। সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুক্তরাজ্য এর সভাপতি কবি মুহাম্মদ ইকবালের সভাপতিত্বে এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক উদয় শঙ্কর দুর্জয় এর সঞ্চালনায় বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশি এই মেলার উদ্বোধন করেন।অনুষ্ঠানে একুশে পদক প্রাপ্ত সংগীত শিল্পী শুভ্র দেব,বাংলা একাডেমি কর্তৃক পুরস্কার প্রাপ্ত কবি শামীম আজাদ, কানাডা থেকে আগত কবি রোকসানা লেইস এবং আবুল হাসিব অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্ট ও কমিউনিটি সেন্টারে বাংলাদেশ বইমেলা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বসবাসরত এবং বিভিন্ন দেশের বাঙালি অভিবাসী, নানা শ্রেণী পেশার মানুষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক কবি, গবেষক ও সাহিত্য প্রেমীদের অংশগ্রহণে জমজমাট হয়ে ওঠে। এছাড়া ইংল্যান্ডের মূলধারার কয়েকজন লেখক ও কবি এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মেলায় ছড়াকার দিলু নাসের, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, কবি মোহাম্মদ মোসাইদ খান ও নাট্যজন স্মৃতি আজাদকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পদক ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। মেলায় স্টলে প্রবাসী ও দেশী লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের বই স্থান পায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পরে পূর্ব লন্ডনের বাংলা টাউন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে পরিচিত। এখানে রয়েছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বাংলাদেশী মানুষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অবদান। প্রবাসে বসবাস করলেও এখানের অভিবাসীরা বাংলাদেশের উন্নয়নে নানামুখী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন।তৃতীয় বাংলায় বসবাসরত দেশ প্রেমিক ও সংস্কৃতিমনা লোকজন মনে করেন, বইমেলা, বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে এই প্রজন্মের সন্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হবে, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। গবেষক ও সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী বলেন,বাংলাদেশী অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে বইমেলা ও বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশী সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘন ঘন হওয়া উচিত। কারণ এতে করে এদেশের নতুন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা হবে, নতুন লেখক ও পাঠক সৃষ্টি হবে।

Manual4 Ad Code

পরিশেষে Warren Buffet একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে আজকের লেখা এখানেই শেষ করছি – “The best investment you can make is an investment in yourself. The more you learn, the more you earn.”

লেখক: গবেষক, শিক্ষা প্রশাসক ও কলাম লেখক; সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

Share





Related News

Comments are Closed

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code