ফেঞ্চুগঞ্জের শ্রেষ্ঠ অদম্য নারীর সাফল্য অর্জনের জীবন গল্প

বিশেষ সংবাদদাতা: সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ ২ জন অদম্য নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক কার্যালয় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার উদ্যোগে ‘অদম্য নারী’-২০২৪ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত ‘শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী সম্মাননা প্রদান’ অনুষ্ঠান গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার সকালে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও সঞ্চালক ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) খাদিজা খাতুন উপজেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ ২ জন অদম্য নারী অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী মনিপুর চা বাগানের লক্ষি মনি গোয়ালা ও নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন যে নারী জোনাকি রানী কর্মকার-কে সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান করেন।
উপজেলা পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী লক্ষি মনি গোয়ালা : ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মনিপুর চা বাগান গ্রামের সেতু গোয়ালা’র স্ত্রী লক্ষি মনি গোয়ালা দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন দরিদ্র চা শ্রমিক ছিলেন। চা বাগানে সামান্য পারিশ্রমিকে কাজ করে তার ও তার বাবার সংসারের খরচ বহন করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিলো।
পাঁচ বছর পূর্বে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা থেকে সরকারিভাবে মুনিপুর চা বাগানে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। উক্ত ছয় মাসের সেলাই মেশিন ট্রেনিংয়ে লক্ষি মনি গোয়ালা প্রশিক্ষণ নেন। ট্রেনিং শেষে উপজেলা পরিষদ কর্তৃক তাকে একটি সেলাই মেশিন প্রদান করে।
লক্ষি মনি গোয়ালার যখন বিবাহ হয়, তখন তার স্বামীর পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। উপজেলা পরিষদ থেকে প্রাপ্ত সেলাই মেশিন দিয়ে তিনি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। পূজা ও ঈদের সময়ে গজ ও থান কাপড় তুলে ব্যবসা করেন, পাশাপশি চা শ্রমিকের কাজও করেন। লক্ষি মনি গোয়ালা তার এলাকায় এ পর্যন্ত ১২ জনকে সেলাই মেশিন ট্রেনিং দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করেছেন। বর্তমানে তার মাসিক আয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এভাবে তিনি সমাজের বিভিন্ন সামাজিক ও আর্থিক সেবামুলক কাজ করে যাচ্ছেন।
দরিদ্র পরিবার থেকে নিজের চেষ্টায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরিতে লক্ষি মনি গোয়ালা উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ অদ্যম নারী।
উপজেলা পর্যায়ে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন যে নারী জোনাকি রানী কর্মকার: ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মনিপুর চা বাগান নিবাসী ঈশ্বর চন্দ্র কর্মকার এর মেয়ে জোনাকি রানী কর্মকার। তার বাবা ছিলো একজন দরিদ্র চা শ্রমিক। তার চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ভাই প্রতিবন্ধী ছিলো। চা বাগানে সামান্য পারিশ্রমিকে কাজ করে তার বাবার সংসারের খরচ বহন খুবই কষ্টকর ছিল। তিনি ছোটবেলায় খুবই চঞ্চল ও সাহসী ছিলেন এবং বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শি ছিলেন। যেমন- ফুটবল, ব্যাটমিন্টন, সাতচারা, গোল্লাছুট ও গাছ থেকে লাফিয়ে পড়া ইত্যাদি। আট বছর বয়সে তিনি মনিপুর চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্র্যতার কারণে তার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ হয়। বাবার অস্বচ্ছল সংসারের হাল ধরার জন্য মনিপুর চা বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে ২২ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ শুরু করেন। তিনি একটু বড় হলে তার বাবা তাকে বিয়ে দেন। বিয়ের তিন বছরের মধ্যে তিনি দুই ছেলে সন্তানের মা হন। কিছুদিন পর তার স্বামী গুরুতর অসুস্থ হন। তখন সে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বার কারণে বাগানের চা শ্রমিকের কাজ থেকে সাময়িক অবসর নেন। চিকিৎসার জন্য তার পরিবার তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যান। তিনি স্বামীকে দেখাশুনা ও সেবা করতে শ্বাশুর বাড়িতে যেতেন কিন্তু তার শাশুড়ি তাকে ভালো ভাবে নিতো না, তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মনে করতো তার কারণে তার স্বামীর এই অবস্থা। জোনাকি রানী কর্মকার স্বামীকে সেবা করতে গেলে সে খুব খুশি হতো। এরপর তার স্বামী কিছুটা সুস্থ হলে সারকারখানা বাজারে ইলেট্রিক সামগ্রী মেরামতের দোকান দেয়, যা বর্তমানেও আছে। তাদের বাড়িতে তার স্বামী মাঝে মাঝে আসতো কিন্তু থাকতে বললে থাকতো না। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর জানতে পারে তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন। স্বামী ২য় স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে থাকে, তার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি।
জোনাকি রানী কর্মকার তিন সন্তান নিয়ে স্বামীহীন সংসারে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ সামলাতে অসহায় হয়ে পড়েন। এক বছর পর তার স্বামী তাদের বাড়িতে এসে টাকা পয়সা চাইতো; না দিলে তাকে মারধর করতো। এভাবে তার জীবনে অনেক কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে না খেয়ে সন্তানদের নিয়ে দুঃখের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেছেন। স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। তার মতো যেন কোন নারী নির্যাতনের স্বীকার না হন। এতো কষ্টের পরও তিনি দমে যাননি। এরই মধ্যে তিনি স্থায়ী চা শ্রমিক হিসেবে গণ্য হন। তিনি চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন দাবী নিয়ে আন্দোলন করতেন। তার আন্দোলন ও নেতৃত্বের জন্য তিনি চা শ্রমিকদের নেতা হয়ে যান। এক পর্যায়ে তাকে চা বাগানের নারী নেতৃত্বের প্রধান বানানো হয়। ৩০০ টাকা মজুরী বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত মনিপুরী চা বাগানের নারী নেতৃত্বের প্রধান ছিলেন তিনি।
জোনাকি রানী কর্মকার চা বাগানের চা সেকশনের নারী পাতা আন্দোলনকারী দফার সভাপতি। গত একবছর পূর্বে চা শ্রমিক কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসেবে মনোনিত করেন। পরবর্তীতে তিনি বিপুল ভোটে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসেবে বিজয়ী হন। বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন সামাজিক ও আর্থিক সেবামুলক কাজ করছেন। তিনি তার জীবনের নির্যাতনের বিভীষিকার স্মৃতি মুছে সমাজে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। তিনি চান তার মতো মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে যেন ঘরে বসে না থাকে, নিজেরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
সকল সমস্যাকে পিছনে ফেলে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া শিখেছেন। স্বামীকে ছাড়া সন্তানদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। জোনাকি রানী কর্মকার ভাবেন তিনি নারী, তিনি সাহসী, তিনি অপরাজিতা। তাই তিনি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী পুরস্কার লাভ করেছেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) খাদিজা খাতুন বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে তৃণমূলের সংগ্রামী নারীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ‘অদম্য নারী অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রমের ধরাবাহিকতায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ২ জন অদম্য নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী সম্মাননা প্রদান অব্যাহত থাকবে।
Related News

এপ্রিলে ধর্ষণের শিকার ১১১, নির্যাতিত ৩৩২ নারী
বৈশাখী নিউজ ডেস্ক: চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে মোট ৩৩২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে।Read More

ঈদের নয়দিনের ছুটিতে সিলেটে ২৮৭ নরমাল ডেলিভারি
বৈশাখী নিউজ ডেস্ক: ঈদে নয়দিনের টানা ছুটিতে সিলেটে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ২৮৭ নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।Read More
Comments are Closed