Main Menu

মাঙ্কিপক্স: আতংকিত না হয়ে সতর্ক থাকুন

মাসুদ পারভেজ: চলতি বছর কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে প্রথম মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স শনাক্ত হয়। গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ২২ হাজার মানুষের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে মাঙ্কিপক্সে প্রাণ হারিয়েছেন ৭১৬ জন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগস্ট মাসে এমপক্স সংক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক জরুরি সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। আফ্রিকার পর এবার ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাসটি। এশিয়াতেও এর সংক্রমণ দেখা গেছে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস লালা, বীর্য, প্রস্রাব, বিষ্ঠা (মল) ইত্যাদির মধ্যে তরল আকারে থাকে। এ ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে যৌন বা অন্যান্য ঘনিষ্ঠ শারীরিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে, যতটা সম্ভব সবার সাথে সমস্ত শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে।

মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত এমন কোনো ব্যক্তির ফুসকুড়ি বা ক্ষতের সাথে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স সাধারণত সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, বিছানা বা অন্যান্য বস্তু ও মুখোমুখি কথোপকথনে শ্বাসপ্রশ্বাস-বাহিত বাষ্পকণার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। সম্পূর্ণ শুকিয়ে ত্বকের নতুন স্তর তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ভাইরাসটি ক্ষতস্থান এবং ফুসকুড়ির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা ইনজেকশনের সুই অন্য কারও শরীরে প্রবেশ করালেও এমপক্স হতে পারে। এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারী এমপক্স আক্রান্ত হলে অনাগত সন্তানও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে নবজাতক শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি (যেমন- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগী, ক্যানসারের রোগী, এইডসের রোগী) এ রোগের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকেন। আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতস্থানের সোয়াব নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী সনাক্ত করা হয়। এ রোগের জন্য কয়েকদিন আগ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো টিকা বা ওষুধ ছিল না। ডব্লিউএইচও জানিয়েছিল, স্মলপক্স বা জলবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। তবে আশার কথা হলো- এ মাসের প্রথম প্রান্তিকে বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাবের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের প্রথম টিকার অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত প্রাণীজাত (জুনোটিক) রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের একটি বিজ্ঞানাগারে এক বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয় বলে একে মাঙ্কিপক্স বলা হয়। এ নামটি বদল করে নতুন বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ এ নাম থেকে মনে হতে পারে বানরই এ রোগের জন্য দায়ী, যা ঠিক নয়। এ রোগটির প্রাদুর্ভাব ১৯৭০ সাল থেকে প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে দেখা যায়। ইতিপূর্বে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আফ্রিকার দেশসমূহে ভ্রমণের ইতিহাস অথবা উক্ত দেশসমূহ হতে আমদানিকৃত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস ছিল। ২০২২ সালের মে মাস থেকে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়াতে মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়া যেতে থাকে; যারা মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার রোগ উপদ্রুত অঞ্চলে ভ্রমণ কিংবা সেদেশের মাঙ্কিপক্সবাহক কোনো প্রাণীর সংস্পর্শেও আসেননি। কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, হয়তো আগেই এ সবদেশে (ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা) মাঙ্কিপক্সের উপস্থিতি ছিল। এখন কোনো অজানা কারণে তা হঠাৎ করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।

আগে থেকে প্রাদুর্ভাব ছিল না এমন দেশগুলোতে এখন পর্যন্ত এ রোগটির সংক্রমণ প্রধানত পুরুষ বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। মাঙ্কিপক্সে একের অধিক বার সংক্রমণ সাধারণত হয় না। এ ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অর্থোপক্স ভাইরাস। এ জাতের ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে গুটিবসন্ত ও কাউপক্স। এ জন্য মাঙ্কিপক্সের সাথে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সের মিল দেখা যায়। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের রয়েছে দুটা ক্লেড বা উপজাতি। একটি হচ্ছে মধ্য আফ্রিকা ক্লেড- এ উপজাতির মাঙ্কিপক্সে মৃত্যুহার দশ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আরেকটি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেড- এ উপজাতির মাঙ্কিপক্সে মৃত্যু তেমন হয়নি। গত বছর নতুন ও আরেকটি গুরুতর ধরনের এমপক্স ক্লেড ১বি সংক্রামিত হওয়ায় এ নিয়ে আবারো উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্লেড ১বি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা বাকি। এটি সম্ভবত আগের ধরনের চেয়ে আরো সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, একইসঙ্গে আরো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।

মাঙ্কিপক্স রোগের সাধারণ উপসর্গগুলো হল- জ্বর (৩৮০ সেন্টিগ্রেডের বেশি তাপমাত্রা), প্রচণ্ড মাথাব্যথা, লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা। সাধারণত জ্বরের তিন দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি ওঠে- যা মুখ থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে হাতের তালু, পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এ উপসর্গগুলো সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে রোগী আরোগ্য লাভ করে। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি উপশম হয়ে যায় বলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না। তবে অনেক সময় রোগীকে আইসোলেশনে রেখে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দিতে হয়। জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। ক্ষতস্থান দ্রুত শুকানোর জন্য ভিটামিন সি জাতীয় ফল বেশি বেশি খেতে হবে। এছাড়া ফুসকুড়ি শুকনো রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিমিত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে যায়। অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী থেকে এ রোগ ছড়ায় না। মাঙ্কিপক্স রোগের লক্ষণসমূহ শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকলে বাহকের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, ‘মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়কেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সাবান বা ডিটারজেন্ট কিংবা জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।’ আক্রান্ত জীবিত বা মৃত বন্যপ্রাণী অথবা এর প্রাকৃতিক পোষক (যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, গিনিপিগ এবং হ্যামস্টার) থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘরের বাইরে না গিয়ে আইসোলেশনে থাকতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে হাতে গ্লাভস ও আঁটসাঁট মাস্ক পড়ে ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থান ও ফুসকুড়িগুলি বেঁধে যেতে হবে। অন্যদের থেকে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব রেখে বসতে হবে। যতটা সম্ভব গণপরিবহন ও পাবলিক টয়লেট ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে।

বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্স রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ঢাকার হজরত শাহজালাল, সিলেটের এম এ জি ওসমানী ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চালু করা হয়েছে মেডিকেল স্ক্রিনিং, প্রস্তুত করা হয়েছে হাসপাতাল ও আইসোলেশন কক্ষ। বিমানবন্দরে এ সংশ্লিষ্ট লিফলেট দেওয়ার পাশাপাশি আগমন স্বাস্থ্য ডেস্কগুলোতে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার রাখা হয়েছে। ঢাকায় প্রয়োজন হলে লক্ষণযুক্ত যাত্রীদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক রোগ হাসপাতাল (আইডিএইচ) ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হবে। সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল ও চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগেও এ ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, যদি কারো এমপক্সের উপসর্গ থাকে বা কোনো সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে অথবা এমপক্সের রোগী আছে- এমন কোনো দেশে ভ্রমণের ২১ দিনের মধ্যে রোগটির কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে 16263 বা 10655 নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

মাঙ্কিপক্স রোগের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন রোগী পাওয়া না গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাওয়া গেছে। সেজন্য বর্তমানে বাংলাদেশ প্রাথমিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। তবে এরমধ্যে আমাদের দেশের মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ আতঙ্ক ও ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর জন্য সকলেরই সরকারি সূত্রের উপর নির্ভরশীল হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। সর্বোপরি এমপক্সের লক্ষণযুক্ত রোগী দেখলে অবশ্যই নির্ধারিত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।

 

Share





Related News

Comments are Closed