Main Menu

রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: বাংলাদেশের ইতিহাসে এ জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের পরম পাওয়া স্বাধীনতা। রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা, আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একদিনেই এদেশ হঠাৎ করে স্বাধীন হয়নি। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রামের রক্তঝরা ইতিহাস। যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, সাগর-নদী, পাহাড়-ঝরনা বেষ্টিত অপূর্ব সুন্দর এদেশকে শকুনরা খাবলে খেয়েছে। এর রক্ত পান করেছে। বাংলার নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে শাসক-শোষকরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। কোনো পর্যায়ে এদেশবাসীর প্রতি এতটুকুন মমতা প্রদর্শন করেনি কেউ। এ আমার দেশ। এই আমার দুঃখীনী বাংলা।

এদেশ যুগে যুগে শাসন ও শোষণ করেছে নানা ভিনদেশি হারমাদরা। প্রায় দু’শো বছর শাসন ও শোষণ করেছে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার হতে ধেয়ে আসা ব্রিটিশ বেনিয়ারা। ওরা শুধু শাসন আর শোষণ করেনি, এদেশের যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি, শাসন-প্রশাসন সব প্রক্রিয়া ভেঙেচুরে একেবারে নিজেদের মত করে সাজিয়েছে।

ফলে ১৯৪৭ সালে এদেশ থেকে বৃটিশরা বিদায় নিলেও তাদের দেয়া সকল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, কূট-কৌশল, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা রয়ে গেছে এখানে। তবুও মন্দের ভালো, আমরা তো স্বাধীনতা পেয়েছি। দুঃখজনক, পাকিস্তান নামে যে দেশটি ইসলামের আদর্শিক চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীন হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণে এদেশ ব্রিটিশ শাসন থেকেও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পশ্চিমা খান পাঠান পাঞ্জাবীদের অপরিণামদর্শী একরোখা নীতিতে বৈষম্যের শিকার পূর্ব বাংলার মানুষরা চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। ওরা প্রথমেই কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমার মায়ের ভাষা বাংলাকে। এমন নিষ্ঠুর ঘটনা এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হয়েছিল।

এ অবস্থায় এ জাতি নিজেদের স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্ত্বার জন্য সকল ভয়কে উপেক্ষা করে পিচঢালা পথে সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। এ পথে এগিয়ে এসেছেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, অসীম সাহসী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আরও অনেকে। বারবার জেল-জুলুম সহ্য করে তাঁদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার কখনো বাংলার মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়নি।
বারবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।

সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছিল প্রতিক্ষণ। এ পথে আবার বুকের খুন ঝরেছে বাংলার নিরপরাধ বহু মানুষের। নিহত হয়েছে শহীদ মতিউর, শহীদ আসাদ। এঁরা সব পূর্বসূরী বাংলার দামাল ছেলে শহীদ রফিক, শফিক, সালাম ও বরকতের উত্তরসূরী। সব সংগ্রামে, সব অধিকার আদায়ে রাজপথে লড়েছে, শহীদ হয়েছে বাঙালি মুসলমানের সন্তানেরা।

অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও গণতন্ত্র হরণের মাঝে হারিয়ে যায় ২২টি বছর। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে পরাজিত হন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। যুদ্ধবাজ সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এদেশের সর্বসাধারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করে। গণতান্ত্রিক শিক্ষা হলো ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া।’

দুর্ভাগ্যজনক, পশ্চিমা সামরিক শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলার আহ্বান জানান। ক্ষমতা হস্থান্তর না করে ইয়াহিয়া ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে মাত্র ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত বাংলাদেশের ওপর পাক হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে এক ভয়াবহ বিধ্বংসী আক্রমণ চালায়। এতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও রংপুরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। নিহত হয় দেশপ্রেমিক অসংখ্য পুলিশ, আনসার, বিডিআর ও ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের সৈন্য।

এ ছিল পাক হানাদার বাহিনীর চরম ভুল সিদ্ধান্ত। তারা গণতন্ত্রকে টুটি চেপে হত্যা করেছে। গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভোটাধিকারকে অপমান করেছে। নিজেরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও ইসলামি সংবিধানের ধারক হয়েও ইসলামি শিক্ষার বিপরীতে বাংলার নিরপরাধ নিরীহ মুসলমানদের উপর অন্যায়ভাবে প্রথম আক্রমণ করেছে। যা এদেশবাসী কখনো প্রত্যাশা করেনি। যখন তাদের বুকে সরাসরি গুলি চালানো হলো, তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলো, নিরীহ মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলো তখন নিরুপায় জনগণ “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায়” বেরিয়ে পড়লো। শুরু হলো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার দামাল ছেলেরা, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়লো হানাদার শত্রুর বিরুদ্ধে। বাংলার মায়েরা নিজ সন্তানকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন রোজা রেখেছে। বৃদ্ধপিতা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ শেষে পুত্র যেন যুদ্ধ শেষে বিজয়ী বেশে ঘরে ফিরে আসে তার জন্য আল্লাহ্র দরবারে অশ্রুবিগলিত কণ্ঠে মুনাজাত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সফল কৌশল ‘গেরিলা যুদ্ধ’ পরিচালিত হলো পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। “শত্রুকে সুবিধামত আক্রমণ করো আর দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাও।” এ ছিল গেরিলা যুদ্ধের প্রধান কৌশল। শত্রুরা বাংলার মুক্তিসেনাদের আক্রমণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের দাম্ভিকতা একেবারে চূর্ণ হয়ে যায়।

বাংলার লেখক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, কবি ও শিল্পী রণসাজে সজ্জিত করে তাদের গান গল্প কবিতা রণ সঙ্গীত। স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র উদ্ভুদ্ধ করে গোটা জাতিকে। বাংলার বন্ধু অনেক দেশও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। প্রতিবেশি ভারত সার্বিকভাবে সাহায্য করে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে। বাংলার স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করে ভারত। মুক্তিপাগল তরুণদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান করে ভারত, রাশিয়া, পূর্ব জার্মানি, কিউবা ও অন্যান্য দেশ। মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ি যুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তান। ৯৩ হাজার নিয়মিত সশ্রস্ত্র সৈন্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমরা ফিরে পাই আমাদের লুণ্ঠিত স্বাধীনতা। চরমভাবে পরাজিত হয় শত্রুসেনা। কারণ তারা নিজেদের মুসলিম হিসেবে জাহির করলেও ইসলামের শিক্ষা থেকে তারা কিছুই শেখেনি। ওরা নিরপরাধ নিরীহ মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে প্রথম আক্রমণ করেছিল বলে মহান আল্লাহ্ তাদের এ দাম্ভিকতা সহ্য করেননি। তাদের করেছেন অপমান। আর তিনি তাঁর অসহায় বান্দা বাংলাদেশের দুর্বল জনগণকে সবলের উপর বিজয় প্রদান করেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ্।

এই প্রথম আমরা নিজেরা নিজেদের ওপর শাসন ও প্রশাসন পরিচালনার সার্বিক অধিকার পেলাম। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর বিগত ৪৯ বছরে নানা চড়াই উৎরাই শেষে আমরা বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। এ পথ আমাদের জন্য কুসমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। যত অসুবিধা থাকুক না কেন আমরা আজ স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। আমাদের নিজস্ব পতাকা আছে; আছে নিজস্ব মানচিত্র। স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। স্বাধীনতা মূলত বাঙালি মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। সাথে সাথে এদেশের ভূমিপুত্র হিন্দু, বৌদ্ধ, উপজাতি এবং খ্রিস্টানদেরও এ স্বাধীনতা শ্রেষ্ঠ অর্জন। তারাও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সক্রিয় সাথি।

স্বাধীনতা কেন আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন? একটু ভেবে দেখলেই আমরা তা সহজেই বুঝতে পারবো। ব্রিটিশ যুগের আগে, ব্রিটিশ যুগে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনকালে একজনও কি বাঙালি মুসলমান রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন? একজনও কি তিনবাহিনীর প্রধান ছিলেন? একজনও কি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী বা নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন? সে আমলগুলোতে কয়জন বাঙালি মুসলমান সচিব ছিলেন? মহাপরিচালক ছিলেন কতজন? কতজন ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক? কতজন ছিলেন ব্যাংকের মালিক বা ব্যাংকার? কতজন ছিলেন উদ্যোক্তা? কতজন ছিলেন শিল্পপতি? কতজন ছিলেন জাহাজ বা বিমানের ক্যাপ্টেন? কয়জন জজ-ব্যারিস্টার ছিলেন? কয়জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন?

নিশ্চিত করে বলা যায় উল্লেখ করার মত তেমন কেউ ছিলেন না। স্বাধীনতা আমাদের সেই শূন্যতা পূরণের অপার দুয়ার খুলে দিয়েছে। আজ কৃষিক্ষেত্র থেকে উঠে আসা কিষাণ-কিষাণী বাংলা মায়ের সন্তানেরা ঐ পদগুলো অলঙ্কৃত করছে। বাংলার প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং কিছু কিছু বড় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার হার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। সুদূর গ্রাম পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিস্তৃত হয়েছে। নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। শহর-নগর-বন্দরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিল কলকারখানা। গড়ে উঠেছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। ইপিজেড, আইসিটি পার্ক। হাসপাতাল-ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে গেছে প্রতিটি উপজেলায়। এক কোটি লোক নিয়োজিত পোশাক শিল্পে। আর এক কোটি লোক বাংলাদেশের দূত হিসেবে কর্মরত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এ জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের পরম পাওয়া স্বাধীনতা। রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা, আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

একদিনেই এদেশ হঠাৎ করে স্বাধীন হয়নি। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রামের রক্তঝরা ইতিহাস। যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক এই সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, সাগর-নদী, পাহাড়-ঝরনা বেষ্টিত অপূর্ব সুন্দর এদেশকে শকুনরা খাবলে খেয়েছে। এর রক্ত পান করেছে। বাংলার নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে শাসক-শোষকরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। কোনো পর্যায়ে এদেশবাসীর প্রতি এতটুকুন মমতা প্রদর্শন করেনি কেউ। এ আমার দেশ। এই আমার দুঃখীনী বাংলা।

এদেশ যুগে যুগে শাসন ও শোষণ করেছে নানা ভিনদেশি হারমাদরা। প্রায় দু’শো বছর শাসন ও শোষণ করেছে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার হতে ধেয়ে আসা ব্রিটিশ বেনিয়ারা। ওরা শুধু শাসন আর শোষণ করেনি, এদেশের যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি, শাসন-প্রশাসন সব প্রক্রিয়া ভেঙেচুরে একেবারে নিজেদের মত করে সাজিয়েছে।

ফলে ১৯৪৭ সালে এদেশ থেকে বৃটিশরা বিদায় নিলেও তাদের দেয়া সকল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, কূট-কৌশল, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা রয়ে গেছে এখানে। তবুও মন্দের ভালো, আমরা তো স্বাধীনতা পেয়েছি। দুঃখজনক, পাকিস্তান নামে যে দেশটি ইসলামের আদর্শিক চেতনাকে ধারণ করে স্বাধীন হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিমাতাসুলভ আচরণে এদেশ ব্রিটিশ শাসন থেকেও খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পশ্চিমা খান পাঠান পাঞ্জাবীদের অপরিণামদর্শী একরোখা নীতিতে বৈষম্যের শিকার পূর্ব বাংলার মানুষরা চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। ওরা প্রথমেই কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমার মায়ের ভাষা বাংলাকে। এমন নিষ্ঠুর ঘটনা এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হয়েছিল।

এ অবস্থায় এ জাতি নিজেদের স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্ত্বার জন্য সকল ভয়কে উপেক্ষা করে পিচঢালা পথে সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। এ পথে এগিয়ে এসেছেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, অসীম সাহসী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আরও অনেকে। বারবার জেল-জুলুম সহ্য করে তাঁদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার উন্নত দেশে।

আজ বাংলার স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীর সৈনিকরা জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বশান্তি মিশনে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করে বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। গৌরবের স্বীকৃতি বয়ে আনছে দেশের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন মহিলা যুদ্ধ বৈমানিক শান্তি মিশনে যোগদান করে নেতৃত্বের পদে আসীন হয়েছেন। ইতোপূর্বে মহিলা পুলিশের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনের কাজ। এখনো তা চলছে অব্যাহত গতিতে। বাংলার এ সমস্ত কীর্তিমান সন্তানরা আফ্রিকার সিয়েরালিয়নে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির সৌরভ বয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছে আরেক খণ্ড বাংলাদেশ। যার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে ঐ জনপদ। সিয়েরালিয়নের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা এখন বাংলা।

যে পাকিস্তান আঁতুড়ঘর হতে পূর্ববাংলাকে চরম অবহেলা করেছে, শাসন ও শোষণ করেছে, অস্ত্রের বলে দাবিয়ে রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সূচকে সে পাকিস্তান আজ বাংলাদেশ থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে। এমন কি প্রতিবেশি বিশাল ভারত থেকেও বাংলাদেশ নানা সূচকে এগিয়ে। এ সবই স্বাধীনতার সুফল।

আজ বাংলার রাজধানী ঢাকা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। হিন্দির আগ্রাসনে পশ্চিবঙ্গ হতে যখন বাংলা ভাষা লুপ্ত হতে যাচ্ছে তখন আমরাই বাংলার সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির অভিভাবক। বাংলা মানেই বাংলাদেশ। বাংলার স্বাধীনতা মানেই আমাদের সকল পর্যায়ের জনসাধারণের উন্নতি ও সমৃদ্ধি। এই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল, আছে ও থাকবে। এর মাঝেই আমাদেরকে বারবার পরিশোধিত হতে হবে। আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। আমার মা, মাটি ও মানুষ; একে নিয়েই আমাদের জীবন। সবচাইতে বড় কথা এদেশ বাঙালি মুসলমানের দেশ।

এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি বিশ্ব ঐতিহ্য ইসলামি সংস্কৃতি। ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে আমরা যদি পূর্ণভাবে অনুশীলন করতে পারি তবে বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি চিরকাল সমুন্নত থাকবে ইনশাআল্লাহ্। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি জেলখানা হতে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে বীরদর্পে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান।” সত্যিকার অর্থে এটিই বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয়।

Share





Comments are Closed