Main Menu

জলের শিশুরা আলোর পথে

সজিব খান, গলাচিপা (পটুয়াখালী) থেকে: জন্ম, বেড়ে ওঠা সবকিছুই নৌকায়। জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে মৃত্যুও নৌকায়। তাই নৌকা কেন্দ্রীক জীবন-যাপন মান্তা স¤প্রদায়ের। ভাসমান এ জনগোষ্ঠীর কাছে শিক্ষা যেন আকাশের চাঁদ। শিক্ষার আলো গায়ে মাখতে উঠতে হবে ডাঙায়। কিন্তু বংশ পরম্পরায় পানিতে ভাসছে তারা। বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবিকার তাগিদে নদ-নদীতে মাছ ধরে শৈশব-কৈশর কাটে। প্রায় তিন যুগের সেই শৃঙ্খল ভেঙে ডাঙায় উঠেছে দুই ভাই। তারা পড়ছে প্রাথমিক স্কুলে। তাদের সময় কাটছে সহপাঠীদের সঙ্গে হৈ-হুলে­ার করে। এই শৃঙ্খল ভেঙেছে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নদীপথের চরমোন্তাজ ইউনিয়নের মান্তা স¤প্রদায়ের দুই শিশু।
তাদের একজন আবুল কালাম আজাদ (১০)। পড়ছে চরমোন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে। তারই ছোট ভাই আব্বাস হোসেন (৬)। সেও ওই স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। ইউনিয়নের স্লুইসের খালে ভাসমান মান্তা পল­ীতে তারাও থাকছে। সেখানে চার শতাধিক মান্তার বসবাস। এরমধ্যে প্রায় এক ১০০ শিশু রয়েছে। এরা সবাই নৌকায় বাস করে। সকলে নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
সোমবার বিকেলে সরেজমিনে স্লুইসের খালের ভাসমান মান্তা পল­ীতে গিয়ে ওই দুই শিশুর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। এসময় নৌকায় বসে বইয়ে মনযোগে থাকা আবুল কালাম আজাদ বলে, ‘আমাগো ভিত্তে (ভেতরে) যারা স্কুলে যায় না হেগো লগে কেউ মেশে না। কথাও কয় না। আমরা যারা স্কুলে যাই হেগো লগে এহন (এখন) সবাই মেশে, কথা কয়। স্কুলের সময় ছাড়া বাব-মা’র লগে আমরা এখনও নদীতে মাছ ধরতে যাই।’ তার পাশে বই হাতে নিয়ে বসে থাকা ছোট ভাই আব্বাস হোসেন বলে, ‘ডিঙিতে দুই ভাই লেহিপড়ি (লখিপড়ি)। ঘন্টা দেলে ইস্কুলে যাই।’ এই দুই শিশুর মা জহুরা বেগম বলেন, ‘আমরা পড়াল্যাহা জানি না। স্বাক্ষর জানি না, টিপসই দেই। কিন্তু আমাগো পোলাপান এহন স্কুলে যায়। এইয়া ভাবতেই নিজের কাছে ভালো লাগে।
স্কুলে পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থী কাকলি আক্তার (১২)। চরমোন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ওর পরিবার এখন আর নৌকায় বসবাস করে না। পড়ালেখায় কাকলির মনযোগ থাকায় পরিবারের লোক পেশা বদল করেছে। কাকলির বাবা এখন স্লুইস বাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে বাস করে। সেই আশ্রয়ণ সংলগ্ন বেড়িবাঁধের ওপর চা-বিস্কিটের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানে গিয়ে বাবার দোকানে বই পড়া অবস্থায় কাকলির সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। কাকলি আক্তার বলে, ‘আমাগো (মান্তা) গোষ্ঠীর পোলাপান ল্যাহাপড়া করে না। বাপ-মা’র লগে নদীতে মাছ ধরে। কিন্তু আমরা কয়েকজন এহন স্কুলে ল্যাহাপড়া করি।’ কাকলির বাবা কামাল হোসেন বলেন, ‘ল্যাহাপড়ায় মেয়ের মন থাহায় আমি নদী থেকে তড়ে উঠছি। মাছ ধরা ছাইরা চা-বিস্কুটের দোকান দেই। যা আয় হয় তা দিয়েই কোনমতে সংসার এবং মাইয়ার (মেয়ের) ল্যাহাপড়া করাই।’
কাকলি আক্তারের বাবা কামাল হোসেন বলেন, ‘মাইয়া (মেয়ে) স্কুলে যায়। ল্যাহাপড়া করে। ওয়ার মা’য়-আমি স্বাক্ষর জানতাম না, টিপসই দিতাম। ওয় ল্যাহাপড়া জানায় আমাগোরে স্বাক্ষর দ্যাওন হিয়াইছে (শিখিয়েছে)। শুধু আবুল কালাম আজাদ, আব্বাস হোসেন ও কাকলি আক্তারই নয়, মান্তা পল­ী ঘুরে তাদের মত প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী পূর্ণিমা (৯) ও একই শ্রেণীর পারভীন (৮) বংশ পরম্পরার শৃঙ্খল ভেঙে স্কুলে যায়। এ প্রতিবেদক মান্তা পল­ীতে গেলে শুরু থেকেই কায়েম আকবর নামের ৮ বছর বয়সের এক মান্তা শিশু তার সঙ্গে ছিল। প্রতিবেদককে সে নৌকায় করে পল্লী ঘুরিয়েছে। নৌকায় নৌকায় গিয়ে যখন বক্তব্য ও তথ্য নেওয়া শেষে প্রতিবেদক ফেরার পথে কায়েম আকবর নামের ওই শিশু তার কাছে একটি আবদার করে। কায়েম আকবর বলে, ‘আমিও আজাদ-আব্বাস-কাকলির মত স্কুলে যামু। ভাইয়া আমারে একটু স্কুলে ভর্তি করাই দ্যান। আমি ল্যাহাপড়া করমু।’ এ প্রতিবেদক তখন চরমোন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকিয়া আক্তারের সঙ্গে কথা বলে কায়েমকে স্কুলে ভর্তির আশ্বাস দিয়ে আসেন।
চরমোন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকিয়া আক্তার বলেন, ‘আমাদের স্কুলে কয়েকজন মান্তা স¤প্রদায়ের শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। ওরা অন্য শিশুদের মতই পড়ালেখা করে। কোন ধরণের সমস্যা হয় না। অন্যদের মতই পড়ালেখায় ওদের ভালো মনযোগ আছে।’
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) গোলাম সগীর বলেন, ‘মান্তা শিশুদের স্কুলে ভর্তির জন্য শিক্ষককরা অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শিশু স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তারা পড়ালেখা করছে। বাকি শিশুদেরও ভর্তি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মো: আলিমউল­াহ বলেন, ‘মান্তারাও আমাদের মত মানুষ। তাদেরকে আলাদা করে দেখা যাবে না। তাই অন্যদের মত তাদের শিশুদেরকেও স্কুলগামী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আশা করি-সবাই স্কুলে যাবে, লেখাপড়া করবে।’

Share





Related News

Comments are Closed