Main Menu

জীবন যুদ্ধে হার না মানা একজন নাজমা’র গল্প

বিশেষ সংবাদদাতা: এ যেন পদ্মাপারের সেই কেতুপুর গ্রাম। এখানেও দারিদ্র আর দুঃখ-শোকে কাটে অসংখ্য কুবের, মালা আর কপিলাদের নিত্যদিন। আছেন হোসেন মিয়ারাও।

বলছি সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নের মোমিনপুর গ্রামের কথা। গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে যে নদীটি তার নাম বড়বাঘা। পুরো গ্রামটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে শান্ত এ নদীটি। এ নদী ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট জনপদ মোমিনপুর। মানব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান ছোঁয়ায় আজকের বাণিজ্যিক শহর সিলেটে স্থাপিত হয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল সহ নাগরিক জীবনের সকল সুযোগ সুবিধা। অথচ অধিকাংশ লোকজনের জীবন ও জীবিকা মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অভিমানী, অবহেলিত মোমিনপুর গ্রামটি নিজেই একসময় বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মানিক বন্ধোপাধ্যায়ের ভাষায় যেন বলতো-‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

এস ও এস শিশু পল্লী সিলেট ২০১৯ইং সালের প্রথমদিকেই ’পরিবার শক্তিশালীকরণ কর্মসূচী’ চালু করেন এই অবহেলিত জনপদে।

এই জনপদেই বসবাস ভাগ্যবিড়ম্বিত শারীরিক প্রতিবন্ধী নাজমা বেগম ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আনহার মিয়া দম্পতির। দু’জনে ভিক্ষা করে যা পেত তাই দিয়ে কোনরকমে খাবার জুটত তাদের। প্রকৃতির নিয়মেই তাদের প্রথম সন্তান সুমাইয়া বেগম আসে তাদের কোল জুড়ে। কিন্তু অভাবের সংসারে ভরণ-পোষণ দিতে না পারায় মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে শিশুটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানার বাড়িতে। পরবর্তীতে তাদের আরেকটি সন্তান হয়। নাম রাখা হয় ঝুমা। দিন, মাস, বছর গুনতে গুনতে বড় হয় ঝুমা। ভর্তি করা হয় স্কুলে। কিন্তু স্কুলের সকল উপকরণ সঠিক সময়ে সরবরাহের অভাবে স্কুলে ঠিকমতো যেতে চাইতো না সে। ঘরে নেই খাবার, পরণে নেই কাপড়, নেই জরা-ব্যাধিতে চিকিৎসা।

এমনই এক নির্মম বাস্তবতায় নাজমা বেগমের পরিবারকে কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিশ্চিত করা হয় সকল প্রকার শিক্ষা উপকরণ ও মধ্যাহ্ন খাবার (মিড্-ডে মিল) এর। শিশুদের পড়াশশুনার জন্য ঘরে কোন চেয়ার-টেবিল ছিলনা, মেঝেতে অথবা বিছানায় বসে পড়াশুনা করতে হতো তাদের। এস ও এস শিশু পল্লী’র সহযোগীতায় শিশুদের পড়াশুনার জন্য চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্তির পর শিশুদেরকে এই কর্মসূচীর মাধ্যমে এস ও এস শিশু পল্লী থেকে সমস্ত শিক্ষা সহায়তা; বই, খাতা, কলম, স্কুল ইউনিফর্ম, স্কুল টিফিন, কোচিং ইত্যাদি যাবতীয় সহায়তা করার ফলে শিশুরা স্কুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। মানব সৃষ্টির ধারায় তাদের পরিবারে হুমাইরা জন্নাত নামে আরেকজন সদস্যের আগমন ঘটে।

ভিক্ষাবৃত্তি নামক অভিশপ্ত পেশা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য পরিবারের আয় বর্ধন এবং জীবিকায়নের সঠিক পন্থা হিসেবে মা নাজমা বেগমকে এস ও এস শিশু পল্লীর সহযোগীতায় ঘরের সাথেই একটি ছোট টং দোকানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। অন্ধ স্বামী আনহার মিয়াও ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী সন্তানদের সময় দিতে থাকেন।

কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনা বেগমকে সমাজে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক একটি পেশা নির্বাচন করে দেয়া। এস ও এস শিশু পল্লী এটি সফলভাবে করতে সক্ষম হয়। ঘরের পাশেই তৈরি করে দেয়া ছোট্ট টং দোকানটি শারীরিক প্রতিবন্ধী নাজমা বেগমের এখন জীবিকায়নের প্রধান অবলম্বন। কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্তির পর মা নাজমা বেগম এস ও এস শিশু পল্লী কতৃক বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত সচেতনতামূলক কর্মসূচী ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, লিঙ্গ সমতা, শিশুযত্ন, শিশু সুরক্ষা, শিশু অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা অর্জন করেন। এস ও এস কর্মীদের নিয়মিত হোম ভিজিটের মাধ্যমে সঠিক পরামর্শ দেওয়ায় পরিবারটি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, ঠিক তখনই অতিমারি করোনা (কোভিড -১৯) পিছিয়ে দিয়েছিল তাদের স্বাভাবিক পথচলা। সরকার লকডাউন ঘোষনা করল, বন্ধ হয়ে গেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বন্ধ হয়ে গেল তাদের পরিবারের আয় রোজগার। সেই দুর্দিনে এস ও এস শিশু পল্লী প্রয়োজনীয় খাদ্য, নগদ অর্থ সহায়তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী প্রভৃতি নিয়মিত সরবরাহের মাধ্যমে নাজমা বেগমের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। এ যেন ঘন আঁধারের মাঝে আলোর বিচ্ছুরণ। ঘুরে দাঁড়ানোর এক অসীম সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

“শিশুদের স্কুল বন্ধ, পরিবারের আয় রোজগার নেই তাই সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো। সেই সময় এস ও এস শিশু পল্লী আমাদের পাশে আলোকবর্তিকার মতো দাঁড়িয়েছে, আমাদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছে, অর্থ সহায়তা করেছে, আমাদের জীবিকায়নে সহায়তা করেছ। এস ও এস শিশু পল্লী সিলেট কে অশেষ ধন্যবাদ জানাই তাঁরা এই পরিস্থিতিতে আমাদের এত সহযোগীতা করেছে যা নিজের আপনজনও করে না।” কৃতজ্ঞতার সুরে বলেন নাজমা বেগম।

ঝুমা বেগম এখন একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে।
সুমাইয়া বেগম ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে, এবং হুমাইরা জান্নাত এর এখনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বয়স হয়নি। নাজমা বেগমের পরিবারে ভাল পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিলনা এস ও এস শিশু পল্লী’র সহযোগীতায় তাদের এখন একটি স্যানিটারী টয়লেট হয়েছে। উক্ত কমিউনিটিতে মোট ৪টি গভীর নলকুপ স্থাপন করে দেয় এস ও এস শিশু পল্লী সিলেট।

নাজমা বেগম এখন ব্যাংকে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছেন। স্ব উন্নয়ন দলের (সেল্প হেল্প গ্রুপ ) সদস্য হয়েছেন। ব্যাংকে জমানো টাকা এবং মানুষের সহযোগীতায় নাজমা বেগম একটি ঘর তৈরি করেছেন। তার আশা শিশুরা পড়াশুনা শিখে যেন সমাজে সম্মানজনকভাবে বাঁচতে পারে। সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মানুষ হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় সন্তানদের চোখে মুখে।

এই গল্প শুধু একজন নাজমা বেগমের একার নয়। সঙ্গী-সাথী শত শত পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর এক একটি উপাখ্যান। এর নেপথ্যে নিরলস শক্তি, সাহস ও সহযোগীতা যুগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক শিশু কল্যাণ সংস্থা এস ও এস শিশু পল্লী সিলেট।

 

 

Share





Related News

Comments are Closed