Main Menu

বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে করণীয়

মাসুদ পারভেজ: দেশের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা, জীবন দক্ষতা ও স্বাস্থ্যে ওপর নির্ভর করছে সার্বিক উন্নয়ন তথা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক পরিবর্তনসহ শারীরিক ও আচরণগত আবর্তন তাদের নিয়মিত জীবনযাপনে ছন্দপতন ঘটায়। আকস্মিক এ পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তারা মানসিক চাপে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য হলো- মনের এমন এক অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষ তার নিজের ক্ষমতা বুঝতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং পরিবার ও সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যও অবদান রাখতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা নানা রকম মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। হরমোনের নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার চাপ। মা-বাবার সাথে মানসিক দূরত্ব, নাগরিক জীবনে একক পরিবার কাঠামোর কারণে একাকীত্ব, স্কুলে বা অবসর সময়ে সমবয়সীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, বুলিং – এসব কারণে মানসিক চাপ আরো বাড়তে থাকে। আবার এ বয়সে স্বাধীন মতামত প্রকাশে প্রবল আগ্রহ, অসামাজিক কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়া ও অভিভাবকের ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে চলার প্রবণতা কারণে অভিভাবকদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ায় তারা। একারণে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ থেকে ধূমপান বা মাদক গ্রহণ কিংবা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে যায় অনেকে। আবেগকেন্দ্রিক প্রবণতা, ভালো লাগা বা পছন্দের বিষয়ে উপেক্ষাকে কেন্দ্র করে আত্মহননের পথও বেছে নেয় কেউ কেউ। এছাড়া নিষিদ্ধ বিষয় ও বন্ধুমহলের প্রতি তীব্র আর্কষণ, মুড সুইং, অতি নৈতিকতা, অতিধার্মিকতা কিংবা অতি আধুনিকতার প্রভাব, শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বিগ্নতা, দিবাস্বপ্ন দেখার মতো কৈশোরকেন্দ্রিক বিষয়েরও অবতারণা হতে পারে কিশোর-কিশোরীদের।

কৈশোরকাল সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে সঠিক পথ দেখাতে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। এদের সঙ্গে খুব খোলামেলা বা রক্ষণশীল—উভয় ধরনের আচরণই বিপজ্জনক। তাই এ বয়সী কিশোর-কিশোরীর খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে শারীরিক ও মানসিক-সব ধরনের বিকাশকে ঘিরে অভিভাবকদের নিতে হবে বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবিক পদক্ষেপ। অনেক সময় মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপে দিনের বেশি সময় কাটানোর কারণে তারা খেলাধুলা, পড়াশোনা, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাতেও কমাতে শুরু করে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে কিশোরীদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো, ব্যায়াম, বই পড়া, চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা, জ্ঞানী-গুণীজনের জীবনী, সফল ব্যক্তির বিভিন্ন উপদেশমূলক বাণী পড়তে উৎসাহী করে তুলতে হবে।।

আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখনো ছেলে এবং মেয়েকে সমান চোখে দেখা হয় না। মেয়ে শিশুদের প্রতি অযত্ন আর অবহেলা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার হয় মেয়েরা। অনেক সময় ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েকে পরিবারে খাটো করে দেখা হয়, ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাকে অবহেলা করা হয়। এভাবে মর্যাদাহীনভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে মেয়েরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো নিজের মর্যাদা বা অধিকারও বুঝতে পারে না। কিশোর-কিশোরী উভয়কেই ‘ছেলে ও মেয়ের সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার’ এ বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে হবে। সে অনুযায়ী একজন কিশোরীকে লেখাপড়া ও অন্যান্য ভালো কাজ দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে একজন পুরুষের পাশাপাশি তারও মাথা উঁচু করে চলার ক্ষমতা থাকে।

পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি কিশোরদেরও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পারিবারিকভাবে শিক্ষা দিতে হবে যেন রাস্তা-ঘাটে কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা, বাজে মন্তব্য বা ইভটিজিং না করে। অভিভাবক ও পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে কিশোর-কিশোরীরা যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়ক হবে। তাই কিশোর-কিশোরীরা প্রয়োজনীয় তথ্য ও সচেতনতার অভাবে সামান্য ভুলও যেন না করে সেব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।

যদি তারা মা–বাবার কাছ থেকে বিজ্ঞানসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ গাইডলাইন পায়, তাহলে তাদের পথভ্রষ্ট হওয়া সম্ভাবনা কমে যায়। এ ক্ষেত্রে মা–বাবাকে কিশোরকালীন পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী আচরণ করতে হবে। একটি কিশোর বা কিশোরী খুব সংগত কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে জড়াতে পারে। সে ক্ষেত্র কী করণীয়? তার ওপর রাগারাগি করে কিংবা তাকে ঘরে বন্দী করে বিছিন্ন করে দেওয়া উচিৎ নয়। কারণ তার কোন ক্ষতি মানেই আপনার ক্ষতি। তাই একজন সহনশীল ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের সমস্যাটিকে আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সমাধান পেতে হবে। এ বয়সটি যেহেতু আবেগ দিয়ে ভরপুর থাকে, তাই আবেগ, ভালোবাসা দিয়েই তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। পারিবারিক আদর্শ, মূল্যবোধ এবং যথাযথ মনিটরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক স্বাস্থ্য ও প্রতিটি মানসিক চাহিদার সঙ্গে মা–বাবার আন্তঃসংযোগ থাকা জরুরি। খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে পড়াশোনা, পছন্দ-অপছন্দ, বন্ধু নির্ধারণ—প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের থাকতে হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনিটরিং। বয়ঃসন্ধিকালকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রারম্ভিক নির্ধারক হিসেবে অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম।

কিশোর-কিশোরীরা সমাজের একটি বৃহত্তর অংশ। জাতীয় স্বার্থে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনের করতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থার জাতীয় ও মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। তাদের সঠিক বেড়ে ওঠায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব। মূলত কিশোর-কিশোরীদের প্রধান মিথস্ক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় স্কুল বা কলেজ। একটি স্কুল এবং সেখানকার শিক্ষকমণ্ডলী তাদের জীবনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বয়সে মা–বাবার চেয়ে তারা শিক্ষকদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে। তথ্যভিত্তিক জ্ঞানভান্ডার দিয়ে একজন শিক্ষক তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ম্যাজিক্যাল ক্ষমতা রাখেন। তাই শিক্ষককে হতে হবে বন্ধু, দার্শনিক এবং একই সঙ্গে জীবন্ত গাইডলাইন। শিক্ষকের অ্যাপ্রিসিয়েশন, ইচিবাচক মনোভাব- এ বয়সীদের মোটিভেশন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, এ বয়সী ছেলেমেয়েরা পারিবারিক অনুশাসন ও ধর্মীয় আদর্শকে কেন্দ্র করে নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের আদর্শ তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞান, মূল্যবোধের বিকাশ ও চর্চায় বিশেষ করে জীবন-জীবনাচার, বন্ধু-পরিবার, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের প্রতি দায়িত্ব–কর্তব্য বিষয়ক কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক ধর্মীয় জ্ঞান কিশোর-কিশোরীদের জীবন গঠনে রাখতে পারে অসাধারণ ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তথ্য-প্রযুক্তির বিকশেরে এসময় কিশোর-কিশোরীরা ঘরে ও বাইরে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে, তার থেকে রক্ষা করে দেশীয় মূলধারার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দিকে ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্বটি নিতে হবে আমাদেরকেই।

যথাযথ পারিবারিক আচরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এবং দেশীয় মিডিয়াগুলোর ইতিবাচক ও শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে অধিক হারে তুলে ধরতে হবে। ইন্টারনেট সার্ফিংয়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়গুলো একাডেমিকভাবে কিশোর-কিশোরীদের জানানোর জন্য সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ বাকিদেরও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারিক, সমাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপদ কিশোর-কিশোরীরা হবে দায়িত্বশীল এবং ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার প্রকৃত কারিগর। পিআইডি ফিচার

Share





Related News

Comments are Closed