Main Menu

কিশোর গ্যাং : নেপথ্যের প্রভাব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: ‘কিশোর গ্যাং’ সমসাময়িককালে আমাদের সমাজে বহুল আলোচিত-সমালোচিত একটি সামাজিক আতংকের নাম। সাধারণত, সদ্য শৈশব পেরোনো ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর বালকদের সংঘবদ্ধ চক্র, গোষ্ঠী বা দলকে ‘কিশোর গ্যাং’ বলা হয়। তবে এ চক্রে ১৮, ১৯ ও ২০ বছর বয়সী বয়ঃসন্ধিকালীন যুবকদেরও দেখা যায়। প্রায় দুই দশক আগে এমন সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা ঘটে। বর্তমানে তা শুধু সামাজিক নয় রাজনৈতিক অবক্ষয়েরও রূপ পরিগ্রহ করেছে। এভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের সংমিশ্রণে বর্তমানে এটা এক ভয়ংকর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে এটা গণআতংকে পরিণত হয়েছে।

অতিসম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরে কিশোর গ্যাংয়ের কবল হতে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে এদেরই হামলায় গুরুতর আহত কোরবান আলী নামে এক চিকিৎসকের নির্মম মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাং নিয়ে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় কিশোর গ্যাং কর্তৃক জনসম্মুখে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবির হত্যার ঘটনায় কিশোর গ্যাং কালচারটি সারাদেশে আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে গণমাধ্যম ও প্রশাসনের যৌথ তদন্তে দেশব্যাপী এর ভয়ার্ত চিত্র ফুটে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, সারাদেশে পাঁচশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় আছে। এদের সদস্য সংখ্যা ৫-৬ হাজার। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ১০, ১৫, ২০, ২৫.., ৫০ জন পর্যন্ত সদস্য থাকে।

প্রথমাবস্থায় রাজধানীতে এর প্রভাব দেখা গেলেও এখন তা সমগ্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে প্রবিষ্ট বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তাদের পোশাক, চুলের কাটিং, চলন, বচন প্রভৃতি জীবনাচারে এক অভিন্ন ও অস্বাভাবিক স্টাইল পরিলক্ষিত হয় যা দ্বারা এদেরকে সমাজের অন্যদের থেকে সহজে আলাদাভাবে নির্ণয় করা যায়। এই অস্বাভাবিকতা তাদের মধ্যে একধরনের উন্মাদনা ভাব সৃষ্টি করে।

গ্যাংগুলোর নামের মধ্যেও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়, যেমন,বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, একে-৪৭, সুজন ফাইটার, ফাইভস্টার, তুফান, ক্যাবরা, ভাইপার, নাইন এমএম বয়েজ, জিইউ ইত্যাদি বিচিত্র। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নাম বিকৃত করেও তারা নিজেকে বিদঘুটেভাবে সমাজে উপস্থাপন করে থাকে; যেমন- পারিবারিক নাম কালাম, ছালাম, হান্নান হলে গ্যাং কালচারে নাম হয় কাইল্ল্যা বা কাল্লু, ছইল্ল্যা বা ছল্লু, হইন্ন্যা বা হন্নু ইত্যাদি। দুর্র্ধর্ষরা নামের আগে কখনো ‘হিটার’ শব্দটাও জুড়িয়ে দেয়। চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, জমিদখল, চাঁদাবাজি, খুন, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ ও ব্যবহার, ইভটিজিংয়ের মতো গর্হিত সব অপরাধের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে এরা জড়িত থাকে। যে বেশি ভায়োলেন্স বা ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে সে ‘গ্যাং স্টার’ বনে গিয়ে পুরো গ্যাংটাকে নেতৃত্ব দেয়। সে দায়বদ্ধ থাকে ‘বড় ভাই’ এর কাছে।

এই ‘বড় ভাই’-ই হলো রাজনৈতিক দলের একজন কালোতালিভুক্ত সক্রিয় নেতা অথবা সদস্য। চট্টগ্রামে ওই চিকিৎসক হত্যাকারী কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্য পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ সহ-সভাপতির নাম উঠে এসেছে। এমনকি তার নেতৃত্বাধীন কিশোর গ্যাংয়ের টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা রীতিমতো উদ্বেগের! চট্টগ্রাম নগরে সক্রিয় রয়েছে ২০০টি গ্যাং যারা নগরের ৪৫টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ছয় বছরে ৩৪টি খুনসহ মোট ৫৪৮ অপরাধ সংঘটন করেছে। বিচারাধীন রয়েছে ২২৩২টি মামলা। এদের নেপথ্যে রয়েছে ‘বড় ভাই’ নামক ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন সরকারদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাদের সারাসরি প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তারা দিনে-দিনে এত হিংস্র হয়ে উঠেছে।
ঢাকায় সক্রিয় ৮০টি গ্যাংয়ের নেপথ্যে সার্বিক সঞ্চালক ২১ জন কাউন্সিলর। শুধু ২০২৩ সালেই সেখানে সংঘটিত ২৫টি খুনের ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে মর্মে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ছিন্নমূল স্তরের। সাধারণত: পারিবারিক কলহ, অশিক্ষা, আর্থিক অনটন, সামাজিক অবহেলা, মাদকাসক্ত কারণেই শৈশব-কৈশোর থেকেই তারা বিপথে ধাবিত হয়। তবে, সবচেয়ে ঘৃণ্য কারণ হলো, অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এদেরকে অপব্যবহার। অর্থাৎ, একশ্রেণীর স্থানীয় রাজনীতিকরা তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থে এ ধরনের অবহেলিত কিশোরদের অবুঝ ও বিচ্ছন্ন জীবনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে অপব্যবহার করে আসছে। এদের দিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমিদখল এবং খুনখারাবির মতো জঘন্য অপরাধ ঘটিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা হয়। সুসংহত করা হয় নিজের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থানকে। ভয়ংকর হলোÑ রাজনৈতিক আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে স্থানীয় প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারে না।

অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ সবকিছু জানার পরেও ইচ্ছাকৃতভাবে হাল ছেড়ে দেয়। তাদের নাকের ডগায় এই ভয়ংকর গ্যাং কালচার চর্চিত হয়। প্রতিটি থানায় এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে এদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিন্তু যথার্থ নজরদারি নেই। বলাবাহুল্য, এই অপসংস্কৃতি রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির নামে অপরাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইচ্ছাকৃত উদাসীনতায় বা দায়িত্বহীনতায় ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করে তা এখন এমন ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাবৎ রাজনীতি ও প্রশাসন কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না।

গ্যাংয়ের দ্বারা কোনো অঘটন ঘটলে সেটাকে ঘিরেই কিছুদিন প্রশাসন তৎপর থাকে; তখন, রাজনীতিকরা মুখরোচক ও শ্রুতিরোচক কিছু নির্বাচিত নীতিবাক্য দিয়ে মায়াকান্না দেখায় বা সাময়িক সচেতনতা প্রকাশ করে। কিন্তু কেউ এই ভয়ংকর দুরাবস্থার কবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে বাঁচাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষেপ নেয়নি আঁধারে ছিঁটকে পড়া এসব অবুঝ কিশোরদের আলোর পথে ফেরাতে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কিশোর গ্যাং অপরাধীদের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বিচার ও শাস্তি দানে তাদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণ আসামির মতো তাদের প্রতি আচরণ না করার এবং কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সংশোধনে এনে কর্মমুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছেন। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক নির্দেশনা।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সারাদেশে মোট তিনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে টঙ্গীতে ৩০০ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে রয়েছে ৯০৯ জন এবং যশোরে ১৫০ জনের বিপরীতে রয়েছে ৩৫৩ জন; শুধু বালিকা কেন্দ্র হিসেবে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ১৫০ জনের বিপরীতে রয়েছে ৮৯ জন [২০২২ সালের তথ্য ]। অর্থাৎ গড় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক অপরাধী রাখা হচ্ছে যা অবশ্যই তাদের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। দেশে দিন দিন এ জাতীয় অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না।

তাই উন্নয়ন কেন্দ্রে সেবার মান নিশ্চিতপূর্বক এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ; কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোররা মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়াচ্ছে। তাহলে তারা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? রাষ্ট্রের এমন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও অপরাধী উন্নয়নের বার্ষিক পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদন জনগণের সৌজন্যে তারা যথার্থভাবে উপস্থাপন করে না। ফলে তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি অনেকটাই অজানা থেকে যাচ্ছে। কিশোর কেন্দ্রে বন্দী হওয়ার আগেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত। সেটা কতটুকু রাখছে? অবস্থাদৃষ্টে এসব প্রশ্ন এখন জন্ম নিচ্ছে। এ দুরাবস্থা উত্তরণের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও উন্মুক্ত সেমিনার করা উচিত।

সবচেয় বড় কথা, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা। গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এসব কিশোরদের রাজনৈতিক অপব্যবহারের কারণেই মূলত পরিস্থিতি এমন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুতরাং যেখানে অপরাজনৈতিক ইন্ধন বা প্ররোচনা জড়িত সেখানে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগ বা শাখাসমূহ কতটুকুই বা কাজ করতে পারবে তা যথেষ্ট সন্দিহান। যেখানে রাজনীতিকদের নৈতিক দায় ছিল এসব কিশোরদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আলোর পথে ধাবিত করার সেখানে চিত্রটা গ্রেফ উল্টো।

মনে রাখা উচিত, এরা আমাদেরই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের নষ্ট করার ফলে এর খেসারত এখন সবাইকে দিতে হচ্ছে। এখনই এদের লাগাম টেনে না ধরলে সামনে সবার জন্য আরো ভয়ংকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এ লক্ষ্যে এদের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকদেরও কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ‘বড় ভাই’ নামক অদৃশ্য গডফাদারদের আজো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। কালেভাদ্রে দু-একজন ‘বড় ভাই’ ধরা পড়লেও তা আইনের ফাঁকে মুক্ত হয়ে আরও তীব্রতর বেগে এমন অপকর্ম চালাচ্ছে। ফলে সমস্যা আরও প্রকটতর হয়ে উঠছে।

তাই কিশোর গ্যাংদের নেপথ্য প্রভাবকদের নির্মূল না করতে পারলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। এজন্য প্রচলিত নষ্ট রাজনীতি সংস্কার করা খুবই জরুরি। শুধু সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নয়, এদের জনশক্তিতে পরিণতের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বিভাগসহ দল, মতনির্বিশেষে সবাইকে কাজ করতে হবে। অন্যথায়, এই প্রজন্ম বিনষ্টের দায় সবাইরই ঘারে বর্তাবে। সবাইকেই এর ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট

Share





Comments are Closed