Main Menu

সংবাদপত্রে লেখকের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: আমরা সবাই জানি, সংবাদপত্র হলো একটি জাতির দর্পণ বিশেষ। যেখানে কোনো জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি এবং অর্থনীতিসহ সমুদয় সেক্টরের প্রতিনিধিত্ব করে। আয়নার মতো প্রতিটি পর্যায়ের ভুল-ভ্রান্তি সমূহ তুলে ধরে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা জাতির সামনে উপস্থাপন করে। এক কথায় সংবাদপত্র গোটা জাতির পরামর্শক হিসাবে কাজ করে। আর সরকার সেই পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের কাজ করে থাকে। তাই বলা যায়, স্বাধীন সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যতীত কোনো জাতি কখনো উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারে না।

শুরুতেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো যে, আমি এখানে লেখক বলতে কাদেরকে বুঝাতে চাইছি? আমার আলোচ্য বিষয় অনুযায়ী লেখক হলো তারা, যারা বিভিন্ন জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের সাহিত্য পাতায় লেখালেখি করেন। তা হতে পারে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক কিংবা অন্য যে কোনো পত্রিকা। প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়া অনলাইন পত্র-পত্রিকাও এর অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে, সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায় আমরা সাধারণত ছড়া, কবিতা, গল্প, অণুগল্প, ফিচার, গদ্য ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকি। প্রশ্ন হতে পারে যে, এইসব লেখার ক্ষেত্রে আবার লেখকের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার কী আছে? সাধারণভাবে চিন্তা করলে মনে হয়, সংবাদপত্রে সাহিত্য চর্চার জন্য লেখকের তেমন একটা স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার প্রয়োজন নেই। যতটা প্রয়োজন ততটা তো আছেই! সোজাসাপ্টা চিন্তা করলে বিষয়টি অবশ্য তেমনটাই মনে হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? অবশ্যই না।
সাহিত্যের হাজারো কিসিমের সংজ্ঞার মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা হলো, Literature is nothing but reflection of human mind. আমি মনে করি, সংজ্ঞাটি যৌক্তিক এবং যথার্থ। সাহিত্য মানব মনের প্রতিবিম্ব ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর সাহিত্য যদি মানব মনের প্রতিবিম্ব হয়; তাহলে সাহিত্যের বাইরে কোনো কিছুই নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি যা-ই বলি না কেন… সবকিছুই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। আমরা সংবাদপত্রের সাহিত্য পাতায় যা কিছুই লিখি না কেন… তার সবকিছুই কোনো না কোনো বিভাজনের মধ্যে পড়ে। কারণ আমরা কেউ সমাজের বাইরে না, রাষ্ট্রের বাইরে না। সুতরাং মানব জীবন এবং সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক।

আর এখানেই সংবাদপত্রে লেখার ক্ষেত্রে একজন লেখকের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি আসে। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সবকিছুর উপরে স্বদেশ প্রেম তথা রাষ্ট্রের প্রতি, সংবিধানের প্রতি, আইনের প্রতি, সামাজিক রীতিনীতির প্রতি এবং ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা তথা ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতি একজন লেখক অবশ্যই দায়বদ্ধ। এসব কিছু মেনে নিয়েই একজন লেখকের লিখতে হবে। লেখা উচিত। কেননা এসব না মানলে যেমন অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন হবে তেমন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কাম্য হতে পারে না। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, একজন লেখকের চোখ এবং সাধারণ মানুষের চোখ এক কথা নয়। সাধারণ একজন মানুষের যেখানে দুটি চোখ থাকে; সেখানে একজন লেখকের শত শত চোখ থাকে। তাই সাধারণ মানুষের যতটা দায়বদ্ধতা আছে, একজন কবি বা লেখকের তারচেয়ে অনেক বেশি দায়বদ্ধতা আছে। এইসব দায়বদ্ধতার কথা মনের গহীনে সযত্নে লালন করেই একজন লেখককে লিখতে হয়। কলম ধরতে হয়। আর এটাই হওয়া উচিত। এছাড়াও বলতে হয়, একজন লেখকের হাজারো অনুসারী থাকেন; যারা তার প্রিয় লেখককে অনুসরণ করেন। অন্তত অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। তাই আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একজন কবি কিংবা লেখক অবশ্যই একজন সাধারণ মানুষ নন। তাই তাদের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আসা যাক, লেখকের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। একজন লেখক নানাভাবে সমাজ, রাষ্ট্র এবং জনগণের নিকট দায়বদ্ধ। কিন্তু তাই বলে কি লেখকের স্বাধীনভাবে লেখার স্বাধীনতা নেই? স্বাধীনভাবে লিখতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। পারা উচিত। একজন প্রকৃত লেখক তার পাঠককে যেমন স্বপ্ন দেখাবেন; তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ অসংগতি আলোকচিত্রের ন্যায় তার লেখায় ফুটিয়ে তুলবেন। একজন লেখক মানে একজন সংস্কারক। একজন বিপ্লবী। লেখকের প্রধানতম কাজ-ই হল মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিশা প্রদান করা। সত্য ও ন্যায়ের ঝান্ডাধারী হয়ে সবাইকে আলোক শক্তিতে উদ্ভাসিত করা। ভালোবাসা ও প্রেমের মন্ত্র সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষে-মানুষে বিভেদের দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। কিন্তু একজন লেখক যখন তার এই সমস্ত দায় এবং দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন… তখনই লেখকের স্বাধীনতার প্রশ্নটি বড়ো হয়ে দাঁড়ায়!

প্রিয় পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার জন্য আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। এই ধরনের ঘটনা সারাবিশ্বে কেবল এই একটিই নয়, আরও হাজারে হাজারে ঘটেছে। বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক শত শত কবি, লেখক অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়েছেন। অনেকের লেখা বই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লেখকদেরকে নির্বাসিত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন? এই প্রশ্নের জবাবও আমরা সবাই কম বেশি জানি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, এইসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানলেও জানি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চাই। বুক থেকে বাইরে প্রকাশ করতে ভয় পাই। আর ঠিক এই জায়গাটায়িই হল আজকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

লেখক সমাজের সাধারণত কোনো উচ্চাভিলাষ থাকে না। তারা রাজা, মন্ত্রী, এমপি হতেও আগ্রহী নন। এই যেমন শেক্সপিয়ার। তাকে রাজার রাজা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি কোনো রাজা তো দূরের কথা রাজার প্রতিনিধিও ছিলেন না। তবে অবশ্যই কবি এবং লেখকদের একটি আদর্শিক রাজত্ব আছে। যেখানে তারা সত্য, সুন্দর এবং ন্যায়ের পক্ষে লড়ে যান। অবশ্য তাদের সে লড়াইও ঢাল, তলোয়ার কিংবা বন্দুকের লড়াই না। কলমের লড়াই। মূলত কবি এবং লেখকগণ হলেন কলমযোদ্ধা। তারা তাদের লেখার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ তথা রাষ্ট্র গঠন করতে চান। মানুষের মাঝে উন্নত নৈতিক চরিত্র এবং মূল্যবোধ গঠন করতে চান। সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি বিদূরিত করতে চান। আর এইসব কারণে লেখকের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

একজন লেখক যদি স্বাধীনভাবে লিখতে না পারেন, তিনি যদি চিন্তা, চেতনা, মনে-মননে স্বাধীন না হন… তাহলে তার কলম থেকে যা বেরোবে তা অনেকাংশে আবদ্ধ জলের মতো অথবা খাঁচায় বন্দি সিংহের মতো। যা তার নিজের জন্য যতটা ক্ষতিকর, তারচেয়েও বেশি ক্ষতিকর দেশ তথা জনগণের। সর্বোপরি এর মাধ্যমে যে ক্ষতি হয়, তা এক কথায় অপূরণীয়। আমি বলছি না যে, আমরা একেবারেই স্বাধীনভাবে লিখতে পারছি না। তবে আমি বলতে চাই, আমরা লেখকেরা যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছি; তারচেয়ে আরও বেশি স্বাধীনতা পেলেও আরও ভালো মানের লেখা সম্ভব হবে। যাতে প্রকারান্তরে লেখক যেমন উপকৃত হবে; তেমনি উপকৃত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা গোটা জাতি।

লেখকঃ শিক্ষক, গবেষক ও কলামিস্ট

Share





Comments are Closed