স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য ও আগামীর প্রত্যাশা
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: বাঙালির জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি। কেননা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এই দিনটি আমাদের পাওয়া। আজকের এই দিনটি সমগ্র দেশবাসীর বহুকালের লালিত স্বপ্নের ফল। বাঙালি প্রতিজ্ঞা এবং সংগ্রামের অঙ্গীকারে উদ্দীপ্ত হয় এদিনে। ২৬ মার্চ বাঙালির আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহীয়ান একটি দিন। নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শােষিত মানবের মুক্তির স্বপ্নসাধ পূরণের মহিমায় অমর এ দিন। জাতীয় ঐক্য এবং দেশপ্রেমের অনুভূতিতে গরীয়ান একটি দিন স্বাধীনতা দিবস। প্রতিবছর এ দিনটি আমরা পালন করি আনন্দে, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে এবং জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে। পাশাপাশি আমরা আত্মসমালােচনার মাধ্যমে নিজের অবয়বটি দেখতে চেষ্টা করি মনের আর্শিতে। আত্মজিজ্ঞাসায় আমরা হই জর্জরিত। আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করি দেশকে এগিয়ে নিতে।
স্বাধীনতা মানে শৃঙ্খল ও শােষণের করাল গ্রাস থেকে নিজের মুক্তি, আর আত্মোন্নয়নের পথে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযােগ লাভ। কিন্তু এ সুযােগ আমরা কতখানি সদ্ব্যবহার করেছি, কতখানি আমাদের শুভ অর্জন, তা মূল্যায়ন করে দেখার জন্য প্রতিবছর আমরা পালন করি স্বাধীনতা দিবস। আমরা খতিয়ে দেখি আমাদের ব্যর্থতার নেতিবাচক দিকগুলাে। আর প্রত্যাশা রাখি সুন্দর আগামীতে।যেনো স্বাধীনতার আরেকটি বছর আসার আগে নিজেরা আরেকটু উন্নত হতে পারি। আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারি দেশকে সেই প্রত্যাশা সকলের মাঝেই থাকে। আমরা চেয়েছিলাম শােষণহীন একটি স্বাধীন দেশ, একটি প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন। চেয়েছিলাম শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, গণতান্ত্রিক চেতনায় আমাদের স্বাধীন ও স্বনির্ভর একটি দেশ গড়ে তুলতে আজও স্বাধীনতার স্বাদ দেশের জনগন পায়নি! আমাদের দেশে সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু জনগনের দুঃখ কষ্ট দুর হয়নি!
স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম। আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবে যতগুলো দিন রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস তার মধ্যে অন্যতম। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যেই অসাধারণ নয়, নবীন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার শপথে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন হিসেবেও অনন্যসাধারণ। মূলত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘােষিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এর পরপরই শুরু হয় প্রতিরােধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির ওপর প্রায় দুই যুগব্যাপী যে নিপীড়ন ও শােষণের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালি একত্র হয়েছিল এই দিনে।
স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণা অকস্মাৎ সৃষ্ট কোনো আবেগময় ঘোষণা নয়। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ। এই অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে এই দিনে বাঙালি জাতি আরেক রক্তাক্ত পথে চলতে শুরু করল। অতঃপর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ, সংগ্রাম, মৃত্যু, লাঞ্ছনা ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা লাভ করি বিজয়। হাতে পাই সবুজ-লালের মিশ্রণে তৈরি একটি পতাকা, একটি গর্বিত ভূখন্ড। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এরকম অগণিত আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে প্রত্যাশাকে লালন করে অগ্রসর হয়েছিল, তারপর একাত্তরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পেরিয়ে ছাব্বিশে মার্চে সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়। স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘােষণার মধ্য দিয়ে সেদিন নিপীড়িত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগণের শােষণমুক্তির প্রত্যাশা অর্জন করেছিল এক নতুন দিক-নির্দেশনা, নতুন মাত্রা। সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমস্ত জাতি একাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামে। বাঙালি ছিল শােষিত, অত্যাচারিত এবং সকল ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযােগ-সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই একচেটিয়া করত পাকিস্তানিরা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্তে¡ও বাঙালি ব্রিটিশ শাসনামলের মতােই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছিল। এমনকি, বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতাে দাস করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় উর্দুকে। কিন্তু বীর বাঙালি তা সহ্য করেনি- প্রতিবাদে, সংগ্রামে, আন্দোলনে নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদের সে ষড়যন্ত্র । অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ে শঙ্কিত পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে যে টালবাহানা শুরু করেছিল তাতেই বাঙালি বুঝতে সক্ষম হয় যে, এরা বাঙালিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তখনই ছিড়ে যায় দুর্বল ঐক্যের রশিটা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। ২৬ মার্চ আসে সেই সুযােগ, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘােষণা এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধ। তাই এদিন আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহালগ্ন।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর। দীর্ঘ এই ৫২ বছরে ইতিহাসের পাতায় আছে পাওয়া না পাওয়ার শত কথা। অতীতের সকল দুঃখ কথা ভুলে আগামীর দিনে নতুন প্রত্যাশায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। কেননা এই দেশ বঙ্গবন্ধুর, এ দেশ বাঙালির, এ দেশ আমার আপনার সবার। তাই দেশের উন্নয়নে সকলকেই দেশপ্রেমী হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে!
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট, পাঠান পাড়া (খান বাড়ী) কদমতলী, সিলেট-৩১১১।
Related News

পবিত্র শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী: এ রাত মহামহিমান্বিত, অভাবনীয়। নিশ্চিত পুণ্যের অভাবনীয় খাজাঞ্চি সাজানো রজনী পবিত্রRead More

আর কত স্বপ্ন ঝরলে জাগবে আমাদের বিবেক
শাহ মনসুর আলী নোমান: যানবাহন চালকদের বেপরোয়া আচরণের ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। তাদেরRead More
Comments are Closed