Main Menu

ফকির দুর্ব্বিন শাহ: ভাটি বাংলার মরমি বাউল সাধক

Manual3 Ad Code

আনোয়ার হো‌সেন র‌নি, ছাতক থে‌কে: বাংলা বাউল সঙ্গীতের ইতিহাসে ফকির দুর্ব্বিন শাহ এক অনন্য নাম। ভাটি বাংলার লোকসংগীত আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁকে ভক্তরা ভালোবেসে ডাকেন “জ্ঞানের সাগর”। আধ্যাত্মিক সাধনা, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সহজ-সরল জীবনবোধকে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করেই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার লোকসংগীত ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাব
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো পর্যন্ত ফকির দুর্ব্বিন শাহ রাষ্ট্রীয় কোনো বড় স্বীকৃতি পাননি। অথচ তাঁর গান আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বেঁচে আছে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম শুধু বাংলার নয়, বিশ্বমানবতার ঐতিহ্যের অংশ।

জন্ম ও শৈশব
১৯২১ সালের ২ নভেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন ফকির দুর্ব্বিন শাহ। তাঁর প্রকৃত নাম দুর্ব্বিন শাহ, তবে পরবর্তীতে “দুর্ব্বিন শাহ” নামেই তিনি পরিচিত হন। পিতা সফাত আলী শাহ ছিলেন এক সুফি সাধক এবং মাতা হাসিনা বানু ছিলেন ধার্মিক পীরানী। আধ্যাত্মিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকেই তাঁর শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটে।

Manual3 Ad Code

পড়াশোনার দিক থেকে তিনি অগ্রসর হতে পারেননি—শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন সুরমা নদী পার হয়ে বাগবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবে স্বল্পশিক্ষিত হলেও সঙ্গীতের জগতে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল বিশাল। শৈশবেই গান লেখা ও সুর করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। কৈশোরে গ্রামের আখড়া ও আসরে গান পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি জনমনে পরিচিতি লাভ করেন।

শিল্পীসত্তা ও দর্শন

দুর্ব্বিন শাহ শুধু বাউল ছিলেন না; তিনি ছিলেন “মালজুড়া গানের জনক”। তাঁর গানের বিষয়বস্তুতে প্রেম, ভক্তি, সমাজ ভাবনা, আধ্যাত্মিক সাধনা ও মানবতাবাদ একত্রিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতে—“মানুষের ভেতরেই লুকিয়ে আছে সত্যের দরজা।”

Manual1 Ad Code

দেহতত্ত্ব, সুফি দর্শন ও সহজ বোধগম্য উপমার মাধ্যমে তিনি গান রচনা করতেন। এ কারণেই সাধারণ মানুষ সহজেই তাঁর গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারত। গ্রামবাংলার মানুষ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত সমাজ—সবাই তাঁর গানে খুঁজে পেত জীবনের সত্য, ভালোবাসা ও মুক্তির বাণী।

সাহিত্যকীর্তি
ফকির দুর্ব্বিন শাহ প্রায় এক হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে প্রায় চার শতাধিক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো—
• প্রেমসাগর পল্লীগীতি (প্রথম থেকে পঞ্চম খণ্ড)
• পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি
• দুর্ব্বিন শাহ সমগ্র
তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—
• “নামাজ আমার হইল না আদায়”
• “আমি জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে”
• “সুখের নিশি প্রভাত হলো”
• “ছাড়িয়া যাইও না বন্ধু রে”
• “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”
এই গানগুলো শুধু সুরের আবেদনেই নয়, বরং দার্শনিক ও মানবিক বার্তার কারণেও কালজয়ী হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজচেতনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুর্ব্বিন শাহ অসংখ্য জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশন করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহরে প্রতিধ্বনিত হয়। মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে তিনি সঞ্চার করেছিলেন সাহস ও আশা। যদিও তিনি সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নেননি, তাঁর গানই ছিল এক ধরনের মানসিক অস্ত্র, যা মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি
দুর্ব্বিন শাহ আন্তর্জাতিক পরিসরেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে গান পরিবেশন করেন। সেখানেই শ্রোতারা তাঁকে “জ্ঞানের সাগর” উপাধিতে ভূষিত করেন।এছাড়া ১৯৭৪ সালে ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”-তে তাঁর গাওয়া “নামাজ আমার হইল না আদায়” গানটি ব্যবহার করা হয়, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম অমর করে রাখে।

দুর্ব্বিন শাহ মাত্র সাত বছর বয়সে পিতৃহারা হন। ১৯৪৬ সালে তিনি সুরফা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তবে বর্তমানে জীবিত আছেন কেবল কনিষ্ঠ পুত্র আলম শাহ। সহজ-সরল জীবনযাপনই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। নাম, খ্যাতি বা সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না। মানবপ্রেম, সত্য ও ভক্তিই ছিল তাঁর জীবনের মূল শক্তি।

Manual2 Ad Code

১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুর্ব্বিন শাহ নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ছাতক শহরের এক উঁচু টিলায় সমাধিস্থ করা হয়, যা আজ “দুর্ব্বিন টিলা” নামে পরিচিত। প্রতি বছর সেখানে অসংখ্য মানুষ ভক্তিভরে উপস্থিত হন, গাওয়া হয় তাঁর গান, স্মরণ করা হয় তাঁর অবদান। তাঁর গান শুধু সুরের ঐশ্বর্যে নয়, বরং জীবনের গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে। লালন শাহ, হাসন রাজা ও শাহ আবদুল করিমের মতোই দুর্ব্বিন শাহ বাংলা লোকসঙ্গীতের ধারা সমৃদ্ধ করেছেন।

Manual8 Ad Code

ফকির দুর্ব্বিন শাহ ছিলেন এক মরমি সাধক ও মানবপ্রেমিক বাউল, যিনি সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছিলেন সমাজ, সত্য ও প্রেমের প্রচারে। তাঁর গান আজও গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে মানুষকে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার পথে আহ্বান জানাচ্ছে। তিনি শুধু এক বাউল শিল্পী নন, বরং বাংলার লোকসংগীত ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নক্ষত্র, যাঁর আলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে।

Share





Related News

Comments are Closed

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code