Main Menu

কীর্তিমান আব্দুল আজিজ খান

মুহম্মদ মতিউর রহমান: কর্মের মাঝে মানুষের পরিচয়। কর্ম দু’রকম। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম। অসৎকর্মে কুখ্যাতি, সৎকর্মে সুখ্যাতি অর্জিত হয়। যারা অসৎকর্ম করে তারা সমাজের আবর্জনাস্বরূপ- ঘৃণাভরে তাদেরকে স্মরণ করা হলেও তারা কখনো বরণীয় ও স্মরণীয় হয় না। কিন্তু সৎকর্মের অধিকারীগণ সমাজে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তারা বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়া বিস্তার করে সমাজের নিরাশ্রয়, সম্বলহীন, অসহায়, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষকে শীতল ছায়া দান করে।কীর্তিমান ব্যক্তিরা বাগানে অসংখ্য ফুলের মধ্যে সৌরভ বিস্তারকারী দৃষ্টিনন্দন পেলব সুগন্ধি ফুলের মতো আকর্ষণীয়। ফুল ঝরে গেলেও তার গন্ধ চারদিকের বাতাসকে আমোদিত করে রাখে। কীর্তিমান মানুষেরাও জীবনকালে স্বীয় ব্যক্তিত্ব, মহত্ত¡, নিঃস্বার্থপরতা, পরোপকারিতা, কল্যাণকামিতা ও সুকীর্তির দ্বারা সমাজে আলো বিস্তার করে রাখে, মৃত্যুর পরেও তারা ঝরে পড়া সুগন্ধি ফুলের মতো তাদের সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে দেয়।

উপরোক্ত কথাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করার তাগিদ অনুভব করছি এক অস-াধারণ মহৎ, পরার্থপর, নিঃস্বার্থ সমাজেসেবী, শিক্ষানুরাগী, পরিবেশবাদী, মানবতাবাদী, শাশ্বত আদর্শের পতাকাবাহী উদারপ্রাণ মরহুম আব্দুল আজিজ খানকে স্মরণ করে। তিনি ১৯২৫ সালে সিলেট জেলার ঐতিহ্যবাহী পাঠানপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানীর অন্যতম সেনানায়ক পাঠান বীর সুবানী খানের তিনি অধস্তন বংশধর। কালক্রমে তাঁর বংশধরেরা সুরমা নদীর তীরে গোটাটিকর পাঠানপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। এ ঐতিহ্যবাহী পরিবারের স্বনামখ্যাত ব্যক্তি আব্দুল আজিজ খান শৈশবে মা হারিয়ে চাচীর হাতে প্রতিপালিত হন। শৈশবে পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। এরপর কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক হন। বিশেষত দেশ বিভাগের পূর্বে আসামে রেফারেন্ডাম কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আসাম থেকে ছিন্ন হয়ে সিলেট অঞ্চলকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে গণভোটে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

বিএ ক্লাসে অধ্যয়নকালে দরিদ্রতাবশত তিনি পড়াশুনা চালাতে অক্ষম হয়ে চাকরি গ্রহণ করেন। প্রথমে সিলেট মহিলা কলেজ (বর্তমান সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ) প্রধান সহকারী পদে নিযুক্ত হয়ে কলেজের উন্নয়নে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন। এ কলেজে চাকরি করা ছাড়াও কলেজটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি যে অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সে সম্পর্কে কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক (পরবর্তীতে মদনমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল) কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই ডুবুডুবু কলেজের হাল বিশেষভাবে ধরেছিলেন অধ্যক্ষ গিরীন্দ্রচন্দ্র দত্ত। তাঁর অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন অফিস সহকারী জনাব আব্দুল আজিজ খান। গিরীন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে একটি ছোট কক্ষে উভয়ে বসতেন। এটিই ছিল অধ্যক্ষের কক্ষ এবং এটিই ছিল কলেজ অফিস। সেখানে বসে দিনরাত দুজনে অফিসের কাজ করতেন। তাঁর ‘আজিজ’ ডাকের মধ্যে একটা সম্মোহনী মমতার সুর ফুটে উঠতো এবং আজিজ খানও সবকিছু ভুলে গিয়ে ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতেন। কখন কলেজে এসেছেন এবং কখন বাড়ি ফিরবেন সেটি বড় কথা নয়। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ হয়েছে কিনা সেটিই ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য।’ (জীবন স্মৃতির কিছু কথা, কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী, দৈনিক জালালাবাদ, ২৬ আগস্ট ১৯৯৫)।

স্বল্প বেতনে কলেজে প্রধান সহকারী পদে নিযুক্ত থেকে সংসার পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ায় আব্দুল আজিজ খান কলেজের চাকরি ছেড়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে যোগ দেন। এতে তাঁর সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আসে। কিন্তু পরে ইসলামি আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে সুদভিত্তিক চাকরিতে নির্দ্বিধায় ইস্তফা দিয়ে তিনি সম্পূূর্ণ বেকার হয়ে পড়েন। ঈমানের তাকাদা অনুযায়ী একজন সাচ্চা মুসলিম হিসাবে তিনি আল্লাহর উপর সম্পূর্র্ণ ভরসা করে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দুঃসহ আর্থিক অনটনের মধ্যে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহে হিমশিম খেতে থাকেন। কিন্তু এ অবস্থায়ও তিনি দরিদ্র, অসহায়, অভাবগ্রস্ত, নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের সাহায্য দানে এতটুকুও ত্রুটি করেননি। নিজের কাছে অর্থ না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে কিংবা ধার করে তিনি মানুষকে অকাতরে সাহায্য করেছেন। অনেক সময় নিজে না খেয়ে নিরন্ন মানুষকে আহারের সংস্থান করে দিয়েছেন। তাঁর মতো পরোপকারী, অসহায় দুঃখী মানুষের সাহায্যকারী, আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দানকারী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে নিতান্ত দুর্লভ।

আব্দুল আজিজ খানের সুকৃতি সম্পর্কে সম্যক আলোচনা করা কঠিন। তবে সাধারণভাবে এগুলোকে মোটামুটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা চলে। প্রথমত, তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী, বিশেষত নারীশিক্ষায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা অতিশয় প্রশংসনীয়। দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবী। তৃতীয়ত, দরিদ্র, অসহায়, দুঃখী ও ভাগ্যবিড়ম্বি^ত মানুষকে তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও আশ্রয় ও সাহায্য দানে অকুণ্ঠ চিত্তে এগিয়ে আসতেন। চতুর্থত, একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হয়েও নিরাশ্রয় ও সাহায্যপ্রার্থী অমুসলিমদেরকে তিনি অকাতরে সাহায্য করেছেন। পঞ্চমত, তিনি একজন ঈমানদার সাচ্চা মুসলিম হিসাবে মানবতাবাদী ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।

প্রথমত, সিলেট মহিলা কলেজে চাকরিরত অবস্থায় তিনি সেই কলেজটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করেন, সে বিষয়টি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, তিনি তাঁর নিজ এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের দানকৃত জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসাটি এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, তিনি এ মাদরাসার শুধু প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদানকারীই নন, ভূমির উন্নয়নকল্পে স্বেচ্ছায় শ্রমদানকারী, নির্মাণ কাজে মিস্ত্রির যোগালী, মাদরাসার অফিস পরিচালনকারী, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী, ছাত্র যোগাড়কারী, শিক্ষক নিয়োগকারী, শিক্ষক হিসাবে পাঠদানকারী, তহবিল সংগ্রহকারী ইত্যাদি সব কাজ তিনি নিজ হাতে স€úন্ন করেছেন।মূলত তিনি শুধু উদ্যোক্তা নন, মাদরাসার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এর নির্মাণ, পরিচালনা ও উন্নয়নের সকল পর্যায়ে অর্থ-শ্রম-সময়-চিন্তা-পরিকল্পনা ইত্যাদি সবই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। এরূপ নিঃস্বার্থ, পরোপকারী ও জনকল্যাণকামী মানুষের দৃষ্টান্ত সমাজে দুর্লভ। কলেজ ও মাদরাসা ছাড়াও স্থানীয় অনেক শিক্ষা-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। গরিব-মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহনে, তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার কাজে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। শুধু নিজের ছেলেমেয়েদেরকে (চার ছেলে ছয় মেয়ে) উচ্চ শিক্ষিত করাই নয়, এলাকার সব ছেলেমেয়েকেই তিনি নিজের মনে করে অত্যন্ত মহব্বতের সাথে তাদের লেখাপড়ার খোঁজ-খবর নিতেন এবং যথারীতি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এরূপ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি সমাজে নিতান্ত বিরল।

দ্বিতীয়ত, তিনি কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ও পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে এলাকার নিরক্ষরতা ও অশিক্ষা দূরীকরণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন।নারী শিক্ষার উন্নয়নে তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তিনি এলাকার রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, অশিক্ষা দূরীকরণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও উন্নয়ন, অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ, সমাজ ও জনহিতকর অসংখ্য কাজে তিনি নিরলসভাবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। নিজ এলাকায় ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিবেশ উন্নয়নে তিনি ঈদগাহ, গোরস্থান, রাস্তার ধারে ও খালি জায়গায় অসংখ্য ফলজ বৃক্ষ রোপণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি যেমন পরিবেশ-সচেতন ছিলেন, তেমনি ফলজ বৃক্ষ রোপণে তাঁর আগ্রহ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেন যে, ‘এ জাতীয় বৃক্ষ যখন ফল দেবে, তখন রাস্তার মানুষ, এমনকি পশু-পাখিরাও তা খেয়ে উপকৃত হবে।’ এক্ষেত্রে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষ রোপণে সকলকে উৎসাহিত করেছেন। একটি বিখ্যাত হাদিস, ‘যদি জান যে, আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ তুমি একটি চারাগাছ লাগাও।’ এর দ্বারা পরিবেশ সুরক্ষার প্রতি ইসলামের তাগিদ স€úর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ্র (সা.) এ মহান তাৎপর্যপূর্ণ বাণী বাস্তবায়নে আব্দুল আজিজ খান এলাকায় অসংখ্য বৃক্ষ রোপণ করেছেন। একজন আদর্শ মুসলিম হিসাবে তিনি নবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ফলজ বৃক্ষ রোপণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সদ্কায়ে জারিয়ার কাজ করে গেছেন।

তৃতীয়ত, দরিদ্র, অসহায়, দুঃখী ও ভাগ্যবিড়€ি^ত মানুষকে তিনি সর্বদা সাহায্য করতেন। বিপদে-আপদে, দৈব-দুর্বিপাকে তিনি সবার আগে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতেন। এলাকার ঝগড়া-বিবাদে তিনি মীমাংসাকারীর ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মানুষে মানুষে শান্তি ও স€প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি সর্বদা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। শুধু অর্থ দিয়ে নয়, মূল্যবান পরামর্শ ও নানারূপ সহযোগিতা দিয়ে তিনি সর্বদা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানবসেবা ও জনকল্যাণমূলক কাজে মরহুম আব্দুল আজিজ খানের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর লন্ডন প্রবাসী মেয়ে নীলু রেজার বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে হিন্দু, মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই বসবাস। যে কেউ যেকোনো সমস্যায় পড়লে আব্বা নিজের ভাইয়ের মতো এগিয়ে যান- এই তাঁর স্বভাব।সমাজের নিরীহ, গরিব, অসহায় মানুষের চিকিৎসা, লেখাপড়া, জীবিকা নির্বাহ, বিবাহ-শাদী প্রভৃতি কাজে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন একান্ত আপনজনের মতো।নিজের হাতে যাতে উপার্জন করে স্বাবলম্ব^ী হতে পারে সেজন্য গরিব মানুষদের সেলাইয়ের মেশিন কিনে দিয়েছেন। অনেককে আবার রিকশা কিনে দিয়েছেন। ঝড়-তুফানে ঘর-বাড়ি নষ্ট হলে অথবা যাদের ঘর-বাড়ি নির্মাণ দরকার তাদের ঘরবাড়ি নির্মাণে সাহায্য করেছেন।আব্বা একবার আমার কাছে চিঠি লেখেন। তাতে লেখা ‘তিনি একটা ফান্ড করেছেন অসহায় মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের জন্য। আমি যেন সাহায্য করি এবং আত্মীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে পাঠাই।’

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তিনি দরিদ্র-অসহায় মানুষকে শুধু সাহায্য করে ক্ষান্ত হননি, তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নবীর আদর্শ অনুসরণ করেছেন। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করে। এ কাহিনী আমরা সকলেই জানি যে, একদিন জনৈক ভিক্ষুক রাসূলুল্লাহর (সা.) নিকট সাহায্য চাইলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে, তার ঘরে কিছু আছে কি না? ভিক্ষুক উত্তরে বললো, একটি কম্বল আছে। তিনি তাকে কম্বলটি নিয়ে আসতে বললেন। কম্বল আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত সাহ-াবাদের মধ্যে তা নিলামে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকা ভিক্ষুককে দিয়ে বললেন, এ টাকা দিয়ে একটি কুঠার কিনে কুঠার দিয়ে কাঠ কেটে খড়ি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে তুমি জীবিকার্জনের ব্যবস্থা কর। কিছুদিন পর ভিক্ষুক রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে দেখা করতে এসে বললো, সে এখন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়েছে। মরহুম আব্দুল আজিজ খানও এ শিক্ষার আলোকে গরিব-দুঃখী মানুষদেরকে কাজ করে স্বাবলম্বী হবার পরামর্শ দিতেন।

চতুর্থত, একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হয়েও নিরাশ্রয় ও সাহায্যপ্রার্থী অমুসলিমদেরকে তিনি অকাতরে সাহায্য করেছেন। এমনকি, নিজের জীবন বিপন্ন করেও অন্যকে আশ্রয় ও সাহায্য দানে তিনি কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নির্যাতিত অসহায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেককে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে অথবা নিরাপদে তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। অসংখ্য হিন্দু নারীর ইজ্জত রক্ষায় তিনি তাদেরকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে এবং নিরাপদে অন্যত্র স্থানান্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করেছেন। এজন্য তাঁকে দুঃসহ নির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছে। পাকবাহিনীর দালালদের প্ররোচনায় হিন্দুদের সাহায্যকারী হিসাবে তাঁকে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুধুমাত্র ইসলামি আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসাবে তাঁকে ‘পাকবাহিনীর দালাল’, ‘রাজাকার’ ইত্যাদি বদনামও শুনতে হয়েছে। এ সম্পর্কে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনৈক ভুক্তভোগী ব্যক্তির বয়ান সংক্ষেপে তুলে ধরছি। সিলেটের জনৈক ডাক্তার পরেশ দাস বলেন, ‘এলাকায় সমাজ কল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজের সামর্থ্য না থাকলেও ধার করে সাহায্য করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। আমি নিজেও বার্ধক্যে, আমার বয়স যখন ১৭ তখন থেকেই খান সাহেবের সাথে পরিচয়। তাঁর মতো এমন ভদ্র, নম্র, উদার, মিষ্টভাষী, অমায়িক, সদা হাস্যমুখ, স্নেহশীল, মার্জিত রুচির মানুষ জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। বহু বিচিত্র গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মাঝে। অথচ তিনি ছিলেন অহংকার বিবর্জিত, বিনয়ী এক মাটির মানুষ। …আমার কর্মজীবন ও এ পর্যায়ে পৌঁছার পিছনে যাদের প্রেরণা, আন্তরিক আশীর্বাদ ও সহযোগিতা রয়েছে তাদের মধ্যে খান সাহেব ছিলেন অন্যতম। …দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন আমি ফিরে আসি এলাকায় তখন দেবেন্দ্রনাথ ও তার ছেলে রাজেন্দ্রনাথ এবং বিভিন্ন হিন্দু ও মুসলমানের কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন তথ্যবহুল ঘটনা জানতে পাই। ঘটনার বর্ণনা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠে। দেবেন্দ্রনাথের সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। তখন তারা আব্দুল আজিজ খান সাব কিভাবে স্বাধীনতার সময়ে পাঠানপাড়া (আচার্যপাড়া) হিন্দুদের বসতিসহ তাদেরকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, তা বর্ণনা করেছে। তাদের মুখে আমি শুনেছি আচার্যপাড়া তথা নাথ পরিবারের উপর হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা। …ইরেন্দ্রনাথের বয়স তখন আনুমানিক ১৭ বা ১৮ ছিল। বর্তমানে তার বয়স ৬৫ হবে। তার বক্তব্য হলো- ৭১-এ এলাকার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার বাবা মা তাদের ভাই-বোনকে নিয়ে তৎকালীন মেম্বার আব্দুল আজিজ খানের আশ্রয় নিলে তিনি তাদের সবার প্রাণ রক্ষা এবং মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষায় যে ভূমিকা রেখেছেন তা ভুলার মতো নয়। …খান সাব সেই সময়ে মেয়েদের ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্য নিজ বাড়িতে নিয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর এ ভূমিকার কারণে ১৯৭১-এ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ওরা রক্ষা পায়। তখনকার সময়ে শুধু এই পরিবার নয় আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু স€প্রদায়ের পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা ঝামেলা, পারিবারিক-আর্থিক সকল ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন খান সাব। হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে খান সাবকে কিছু কুচক্রী মহলের ইন্ধনে পাক হানাদার বাহিনী তখনকার লালমাটি ক্যাম্পে নিয়ে বিভিন্নভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। ঐ সময় তিনি সকলের প্রার্থনায় ও উপরওয়ালার আশীর্বাদে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পান।’ (ডা. পরেশ দাস: শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে এক নির্ভীক ব্যক্তিত্ব : আব্দুল আজিজ খান)।

পঞ্চমত, তিনি একজন ঈমানদার সাচ্চা মুসলিম হিসাবে মানবতাবাদী ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ইসলাম মহান স্রষ্টা-প্রদত্ত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা। এ দ্বীন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। মহান স্রষ্টা ইহ ও পরকালে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের পথ হিসাবে এ দ্বীন মানবজাতির জন্য নাযিল করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর দৃঢ় ঈমান এনে নিষ্ঠার সাথে দ্বীন অনুসরণ করে, প্রকৃতপক্ষে সে ইহ ও পরকালে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করে। যখন কোন ব্যক্তি এ শাশ্বত কল্যাণময় দ্বীন উপলব্ধি ও অনুসরণ করে শান্তি ও মুক্তির পথে অগ্রসর হয়, তখন স্বভাবতই তার দায়িত্ব হলো এ পথে অন্যদেরকেও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা। কোন মহৎ ব্যক্তি শুধু নিজের কল্যাণ কামনা করে না, অন্যদেরকেও কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তির পথে আহবান জানায়। মরহুম আব্দুল আজিজ খান ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশুনা করেছেন এবং জেনে-বুঝে এটাকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন এবং অন্যদেরকেও এ পথে আহবান জানিয়েছেন। ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারী হিসাবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে একজন সৎ, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, নিরহঙ্কার, বিনয়ী, পরোপকারী, কল্যাণকামী, মহৎ, উদার মানুষ হিসাবে গড়ে তুলে যেমন সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন, তেমনি ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সকলকে জমায়েত হওয়ার জন্যও তিনি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আন্তরিক আহবান জানিয়েছেন। জীবনে চলার পথে মহানবীর সর্বোত্তম জীবনাদর্শ তাঁকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করেছে এবং তিনি ইসলামকে সমাজে এক বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এরূপ একজন সৎ-কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি তাঁর আপন চরিত্রগুণ ও মহৎ কীর্তিরাজির মাঝেই স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে চির অমর হয়ে থাকবেন।

আব্দুল আজিজ খান ৮৬ বছর বয়সে ২০১১ সালে ইন্তিকাল করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কখনো দেখিনি, তাঁর সাথে আমার কখনো পরিচয় ঘটেনি। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে জেনে এবং বিভিন্ন জনের লেখার মাধ্যমে যৎকিঞ্চিৎ অবগত হয়ে এ মহান ব্যক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আমার হৃদয় আপ্লুত হয়েছে। বস্রার গোলাপকে না দেখেই তার সৌরভের মহিমা শুনে মুগ্ধ হই, কোকিলকে না দেখেই তার মধুর গানে হৃদয় আপ্লুত হয়। পৃথিবীতে অনেক মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে আমরা কখনো দেখিনি, কিন্তু তাদের কীর্তিরাজি শুনে আমরা তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আপ্লুত হই। আব্দুল আজিজ খানও তেমনি বস্রার এক অদেখা গোলাপের সুগন্ধিভরা পাপড়ি, অদৃশ্য কালো কোকিলের হৃদয়মথিত করা গানের কলি অথবা পৃথিবীর অনেক মহাপ্রাণ স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিদেরই একজন। তাঁর উন্নত মহৎ চরিত্র ও জননন্দিত কীর্তিরাজি তাঁকে চিরদিন অমর করে রাখবে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক এবং সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

Share





Related News

Comments are Closed