Main Menu

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার: জুয়ার অ্যাপে নিঃস্ব হচ্ছে দেশের মানুষ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া। জুয়ার আসর বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে বিদেশ থেকে পরিচালিত হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ পাচারের পেছনে স্থানীয় বিভিন্ন এজেন্ট জড়িত রয়েছে। ঘরে বসেই মানুষ বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকছে না। এরপরও জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় অপরাধীদের বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা সদস্যরা।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশ-বিদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আইপিএল, বিপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ জনপ্রিয় সব খেলা সম্প্রচারকালে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে অনলাইন জুয়া বা বিভিন্ন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন। এসব জুয়ার সাইট ভারত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু দেশে তাদের ডিলার বা প্রতিনিধি রয়েছে। তারাই মূলত মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের কাছ থেকে জমা হওয়া জুয়ার টাকা সংগ্রহ করে। এরপর সেই টাকা অনলাইনভিত্তিক ‘বাইন্যান্স’ নামে অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়। এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর করে জুয়ার সাইট মালিকের কাছে পাচার করে। বিট কয়েনে পাচারের বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও এই টাকা পাচার হয়ে থাকে।

জুয়ার এমন ১৮৬টি অ্যাপ ও লিংকের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিটি অ্যাপ ও সাইটে লেনদেনের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি এমএফএস প্রতিষ্ঠানের একটি করে ৫-৬টি এজেন্ট নম্বর দেয়া থাকে। দেশে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। এদের এজেন্ট নম্বরগুলো জুয়াড়িরা দৈনিক ভিত্তিতে এবং লাখে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা কমিশন ভিত্তিতে ভাড়া নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এজেন্ট নম্বর টার্গেট করে জুয়াড়িরা। এ রকম ৩ হাজারের বেশি এজেন্ট নম্বর পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থা। প্রতিটি এজেন্ট নম্বরে মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। দেড় হাজার এজেন্ট নম্বরে মাসে ১৫০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এভাবে বছরে লেনদেন হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকা।

অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং জুয়ার ব্যাপক প্রসারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন জুয়া বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি, উল্টো ভিন্ন মোড়কে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনলাইনের অবারিত দুনিয়ায় জুয়া বা বেটিংয়ের প্রসার রোধে সবার আগে এর প্রচারণা রোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ জরুরি।

অনলাইনে জুয়া বেড়ে যাওয়া এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার সন্দেহে তিন বছরে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানির ৪৮ হাজার ৫৮৬টি ব্যক্তিগত হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে হুণ্ডি সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে এমএফএসের ৫ হাজার ২৯টি এজেন্টশিপ বাতিল এবং ১০ হাজার ৬৬৬টি এজেন্ট হিসাবের লেনদেন ব্লক করা হয়েছে। এতো কিছুর পরেও অনলাইন জুয়া স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ অনলাইনে জুয়া খেলার সাইটগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। এসব অনলাইন সাইটে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। পরে কোনো ব্যক্তি একবার অনলাইন জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়লে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে বিভিন্ন সময়ে অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সংস্থাটি বলছে, ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছে অনলাইন জুয়ার দিকে। কয়েকটি অপরাধী চক্র এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে।

বিটিআরসি জানিয়েছে, অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে নগদ অর্থ, ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড। এগুলোর মাধ্যমেই অপরাধী চক্র দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকে। মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেইম বা জুয়া খেলা হয়। এজন্য দেশে এবং বিদেশে হোস্টকৃত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়। অনলাইন জুয়াড়িরা বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা আদান-প্রদান করে।

প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেশে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপসের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলাসহ বিভিন্ন লিগ ম্যাচকে ঘিরে প্রতি মুহূর্তে অবৈধ অনলাইন জুয়া বা বাজি খেলা চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে প্রকাশ্যে এর হার কমলেও অনলাইনে এ খেলার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং এতে আসক্ত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। রমরমা এ জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ এবং তাদের পরিবার।

সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত ও অনলাইনভিত্তিক সাইট নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিক্যাফ) সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আধুনিক বিশ্বে ছোট-বড় সবার হাতে স্মার্ট ফোনের ছোঁয়া লেগেছে। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটের সুবাদে মানুষ ঘরের কোণে বসে অনলাইনে জুয়া খেলতে পারছেন। অনলাইনে জুয়া খেলা ব্যক্তির পাশেও যদি কেউ বসে থাকেন তিনিও বুঝতে পারবেন না, পাশের ব্যক্তি জুয়া খেলছেন। এভাবে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে।

দেশের ও দেশের বাইরে জনপ্রিয় তারকা অর্থের বিনিময়ে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা করছেন। এতে ওই তারকাদের ভক্তরা সহজেই বিশ্বাস করে জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। আবার বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইট মানুষকে প্রলোভন দেখায়, একবার ওই প্রলোভনে জড়ালে সেখানে স্থায়ীভাবে আটকে যায়। স্মার্টফোনের মাধ্যমে ঘরে বসে সন্তানরা জুয়া খেললেও বাবা-মা সেটি বুঝতে পারছে না। সেজন্য অনলাইন জুয়া বন্ধ করতে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।

আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য বলছেন, দেশে মোবাইলে আর্থিকসেবা সহজ হয়েছে। প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে অসাধু চক্র অনলাইন জুয়া বা বেটিং, গেমিং, ফরেক্স বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও হুন্ডি প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ হতে মুদ্রা পাচার বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত ৩০ জুন রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলছেন, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনলাইন জুয়ার কারণে দেশের বাইরে অর্থপাচারের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

সিআইডি প্রধান বলেন, দেশে অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া) নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চ্যালেঞ্জ তথ্যের ঘাটতি এবং কোনো গবেষণা ও সুনির্দিষ্ট আইন না থাকা। এখন এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন না হলে অর্থ পাচারসহ নানা ধরনের অনলাইনভিত্তিক অপরাধ বাড়বে।

অনলাইন জুয়ার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও। গত ২৪ জুন সচিবালয়ে এক আয়োজন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আমাদের বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়েরা। এমনকি অনেক বয়স্ক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিও এর মধ্যে আসছেন। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ৫০ লাখ মানুষ জুয়ার সাইটগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। অবৈধ জুয়ার সাইটগুলোকে ব্লক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

Share





Related News

Comments are Closed