Main Menu

আব্দুল আজিজ খানকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের দাবীতে স্মারকলিপি

বিশেষ সংবাদদাতা: সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর এলাকার পাঠানপাড়া কদমতলী নিবাসী মরহুম আব্দুল আজিজ খান- কে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রদানের দাবীতে আব্দুল আজিজ খান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সিলেটের জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।

গত ৮ এপ্রিল সোমবার দুপুরে আব্দুল আজিজ খান ফাউন্ডেশনের নেতৃবৃন্দ এই স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ সময় নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান এর হাতে আব্দুল আজিজ খান এর জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখা ৪টি বই উপহার হিসেবে দেয়া হয়।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত দিন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, সমাজ সেবক হিসাবে বাংলাদেশে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁরা সরকারি ভাবে মূল্যায়ণ করে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়ে আসছেন। এটা প্রশংসনীয় কাজ। যা দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এ ধারাবাহিকতায় সিলেটের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ব্যক্তি মরহুম আব্দুল আজিজ খান আজও কোন সরকারি ভাবে জাতীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় এলাকাবাসী ও সিলেটবাসী হতাশ। তাই গুণী ব্যক্তি আব্দুল আজিজ খানকে মরণোত্তর জাতীয় পুরষ্কারে ভুষিত করার জন্য জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা কামনা করা হয়।

আব্দুল আজিজ খান নিন্মলিখিত অবদানের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা লাভ করার যোগ্য। তাঁর অবদানগুলো হচ্ছে-

সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর, পাঠানপাড়া, কদমতলী নিবাসী মরহুম আব্দুল আজিজ খান ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৬ মে ২০১২ খ্রীস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শিক্ষানুরাগী মরহুম আব্দুল আজিজ খান সিলেট রেফারেন্ডাম আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা ছিলেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। অসংখ্য স্মরণীয় কাজ সম্পন্ন করেছেন। বিশেষ করে তিনি বহুবিদ সামাজিক কর্মকান্ডের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের সম্পদ যা ছিলো তা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আমৃত্যু নিয়োজিত থেকে অত্যন্ত সাদাসিদা জীবন যাপন করেন। তাঁর ব্যতিক্রমী বিশেষ বিশেষ অবদানের জন্য সিলেট অঞ্চলের সর্বসাধারণের মধ্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। অথচ আজ পর্যন্ত তিনি কোন জাতীয় পুরষ্কারে ভুষিত হননি। তাঁর সম্পর্কে কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ঐ গ্রন্থগুলোতে সরকারি কমকর্তা, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক আব্দুল আজিজ খান সাহেবকে তাঁদের নিজ নিজ গবেষণায় তাঁর জীবনীর অসাধারণ দিক দর্শন আলোচনা করে সিলেটবাসীকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থগুলো লেখকের লেখায় সিলেটবাসীর মধ্যে এক ব্যতিক্রম আব্দুল আজিজ খান। সংক্ষেপে তাঁর কিছু স্মরণীয় কাজ নিম্নরূপ:

১। মরহুম আব্দুল আজিজ খান সিলেট অঞ্চলে নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ গিরিন্দ্র দত্ত, অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরী সহ কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একাধারে মহিলা কলেজের একাউন্টের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতা করে ও বাড়ী বাড়ী ঘুরে সকাল বিকাল ছাত্রী যোগাড় করেন এবং ছুটির দিনেও হিসাব নিকাশের কাজে ব্যস্ত সময় পার করতেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ শহরের প্রাণকেন্দ্র সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ মহিলা শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় লিখেছেন, ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই ডুবু ডুবু কলেজের হাল বিশেষভাবে ধরে রেখেছিলেন অধ্যক্ষ গিরিন্দ্র দত্ত। তাঁর অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিলেন অফিস করনিক জনাব আব্দুল আজিজ খান। গিরিন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ীতে একটি ছোট কক্ষে উভয়ে বসতেন। এটাই ছিল অধ্যক্ষের কক্ষ এবং এটাই ছিল কলেজের অফিস। সেখানে বসে দিনরাত দু’জনে অফিসের কাজ করতেন। শুধু ক্লাস নেবার জন্য দু’একবার বাইরে যাওয়া ছাড়া গিরিন্দ্র বাবু সারাক্ষণ ঐ কক্ষে বসতেন। তাঁর আজিজ ডাকের মধ্যে একটা সম্মোহনী মমতার সুর ফুটে উঠত এবং আজিজ খানও সব কিছু ভুলে গিয়ে ছায়ারমত তাঁকে অনুসরণ করতেন। প্রতিবেদন দৈনিক জালালাবাদ, ২৬ আগষ্ট ১৯৯৫।

২। উত্তর সিলেট (সদর), দক্ষিণ সিলেট (মৌলভীবাজার), সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলা সমন্বয়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল আসাম প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে আজ বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই জন্য রেফারেন্ডাম আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত গড়ে উঠেছিল। আব্দুল আজিজ খান তৎকালীন রেফারেন্ডাম আন্দোলনের প্রথম সারির একজন নেতা ছিলেন।

গণভোটের ৫৫ হাজারেরও অধিক ভোটে বিজয়ী হয়ে এই অঞ্চল আসাম প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব বাংলার অংশ হয়েছিলো। এই আন্দোলনের উৎসাহ দাতা, নির্দেশক ছিলেন মজলুম জননেতা আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়ামীলীগের পরবর্তী সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ রেফারেন্ডামে জনমত সৃষ্টির জন্য তৎকালিন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধি দল সিলেটে পাঠিয়ে ছিলেন। তারা প্রাচীনতম বখতিয়ার বিবি স্কুলে অবস্থান করে সপ্তাহকাল প্রচার প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে মরহুম আব্দুল আজিজ খান স্মরণীয় অসাধারণ অবদান রেখেছিলেন।

৪। একজন স্বভাবগত সমাজ সেবকের বৈশিষ্ট্য ছিলো তাঁর। এইজন্য এলাকার মানুষ নিজেদের স্বার্থে তাকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। তিনি তখনকার যুগে জনপ্রতিনিদের মধ্যে ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি। কুচাই ইউনিয়নের অত্যন্ত সক্রিয় হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করেন। জনপ্রতিনিধি হিসাবে এলাকার রাস্তাঘাট, পুল, পানি নিস্কাশন সহ অসংখ্য জনহিতকর কাজ অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠায় সম্পন্ন করেন। তাঁর অসংখ্য কাজ ও জনসেবার চিহ্ন এখনও বিদ্যমান থাকায় জনগণ এখনও তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন।

৫। আব্দুল আজিজ খান ১৯৬৯ খ্রী: গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসায় তিনি জমি দান করেন এবং আমৃত্যু মাদ্রাসা কমিটির সেক্রেটারী ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মাদ্রাসায় তিনি ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৬। তিনি তাঁর নিজ গ্রামে ‘পাঠানপাড়া শাহী ঈদগাহ প্রতিষ্ঠাতা, দাতা ও সভাপতি ছিলেন। নৈতিক ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত থাকায় সিলেটবাসীর সকলের প্রিয় ও শ্রদ্ধাপাত্র ছিলেন।

তিনি দক্ষিণ সুরমা এলাকার একজন বিচারিক বা সালশী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জনহিতকর কাজ, জনসেবা, লাইব্রেরী, পাঠাগার প্রতিষ্ঠান, দান-খয়রাত করা, শিক্ষার বিস্তার বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিস্তার করতে নিজের পরিবার পরিজনদের মানবেতর অবস্থায় রেখেও অসহায় মানুয়ের পাশে দাড়িয়েছেন। তাঁর স্মরণে আমার সম্পাদনায় একটি অখন্ড (৫০০ পৃষ্ঠা) স্মারক গ্রস্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অসামান্য অবদান ও অবিস্মরণী কর্মকান্ডের বর্ণনা দিয়ে সারাদেশে লেখক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবিগণ প্রবন্ধ লিখেছেন। দক্ষিণ সুরমা অঞ্চলের সংসদ সদস্য (এমপি) মরহুম মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী অকপট বর্ণনায় স্মারকগ্রন্থে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়েছেন।

৭। ১৯৭১ খ্রী: মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাক বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান। এলাকার হিন্দু জনগণের জানমাল রক্ষায় বিশেষ করে নারীদের ইজ্জত ও বাড়ীঘর রক্ষায় যাবতীয় প্রচেষ্ঠা চালিয়েছিলেন। কুচক্রীদের প্ররোচনায় তাঁকে জেলে নিয়ে অমানষিক নিযার্তন করা হয়। মারের চোটে তার দুটি দাত পড়ে যায়। জনগণের চাপে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার পর তার দাবী অনুযায়ী ১২ জন পাক সৈনিককে ক্লোজ করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে ধবংস প্রাপ্ত হিন্দুদের বাড়ীঘর মেরামত করে দিতে হয়। এইরুপ ঘটনা তৎকালিন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধাদের স্মৃতিচারক বিশেষ করে এলাকার সদ্য প্রয়াত প্রবীন হিন্দু ব্যক্তিত্ব ডাঃ পরেস দাসের প্রবন্ধ।

এমন একজন অসাধারণ, ঐতিহাসিক রত্ন ব্যক্তিত্ব আজো কোন জাতীয় পুরষ্কারে ভুষিত হননি। সিলেট জেলা প্রশাসক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে তাঁর অবদান, কৃতিত্বপূর্ণ কর্মকান্ড উপস্থাপন করে সম্মানজনক জাতীয় পুরষ্কার (মরণোত্তর) প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নেতৃবৃন্দ দাবী জানান।

নেতৃবন্দ ঐতিহাসিক রত্ন ব্যক্তি মরহুম আব্দুল আজিজ খানকে তাঁর কর্ম জীবন মূল্যায়ণ করার লক্ষ্যে সিলেটের জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ ও সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতা কামনা করেন।

Share





Related News

Comments are Closed