Main Menu

নেশার নীল ছোবল ও ইসলামের দিশা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: বছর দুই আগের কথা। সকাল ও দুপুরের সন্ধিক্ষণে পারার এক টং দোকানে বসেছিলাম। আমি ও দোকানি বড় ভাই আলাপ করছিলাম নানা বিষয়ে। এমন সময় গুটি গুটি পায়ে হেঁটে দোকানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন একজন মা। বদনে চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার রেখা স্পষ্ট। দোকানির কাছেই এসেছেন, ব্যক্ত করা শুরু করলেন মনের গহীনে থাকা দুঃখ ও সিদ্ধান্তহীনতার কথা। চার ছেলের জননী এ মায়ের চিন্তাটা মূলত তার ত্রিশ ঊর্ধ্ব বড় ছেলেকে ঘিরে। তিনি ছেলেকে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না! ভাবছেন পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিবেন। যাক কিছু দিন জেল খেটে আসুক, তাও যদি ভালো হয়! মাদকের নেশাটা তবুও যদি ছাড়ানো যায়।

পরক্ষণে নিজেই গিহি কন্ঠে বলা শুরু করলেন জেলে দিয়েও তো লাভ নেই, জেলের ভেতরেও নেশা দ্রব্যের ব্যবস্থা হয়ে যায়! এদিকে মাদকাসক্ত ছেলেটার স্ত্রীও ডিভোর্স নিয়ে চলে গেছে। কোন কাজ করে না, সময় মতো নেশা করতে না পারলে পাগলের মতো হয়ে যায়, ঘর থেকে ছাড়া পেলেই উধাও! টাকা না পেলে তো হুলস্থুল কান্ড করে বসে, ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র বিক্রি করে হলেও নেশা করতেই হবে, না হলেই না। তাকে নিয়ে পুরো পরিবার শঙ্কিত, না জানি কখন কী বড় বিপত্তি ঘটিয়ে বসে। গর্ভধারিনী মা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন শত স্বপ্নের বড় ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দিবেন কিনা!

মাস খানিক আগের ঘটনা। আমাদের পাশের গ্রামে একটি খুন হয়। খুন হন সদ্য বার্ধক্য স্পর্শ করা একজন মা। কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। খুনি দূরের কেউ নয়, নিহত মায়ের যুবক ছেলে। জ্বি , ছেলেই তার মাকে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। যে মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলো, হাসি মুখে প্রসব বেদনা সয়ে, বুকের দুধ খায়িয়ে, স্নেহ-প্রীতি-মমতায়, পরম যত্নে বড় করেছিলো সে ছেলেই বড় হয়ে মাকে খুন করলো। ছেলেটি ছিলো মাদকাসক্ত, নেশা এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে মায়ের বাঁচার আকুতি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি, মায়ের ঘার থেকে ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসা তাজা রক্তও তার হৃদয়ে আচর কাটেনি। কোন বন্য পশুও এতোটা নির্মম হতে পারে না, যতটা ‘হিংস্র’ খুনি যুবককে মাদক বানিয়েছে।

আমাদের চোখের সামনে এরকম হাজারো অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুর ঘটনা আছে, প্রত্যহ ঘটে চলছে। ঐশীর কথা তো মনে আছে নিশ্চয়ই। ঢাকায় বাবা-মাকে খুন করেছিলো যে মাদকাসক্ত মেয়েটি। এরকম হাজারো ঐশী তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে মাদক নামক বিষাক্ত কালকেউটে। মাদকের ভয়াবহতা ও সামাজিক কুপ্রভাব এতোটাই স্পষ্ট যে জ্ঞানসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট। এর নীল ছোবলে জর্জরিত সারা বিশ্বলোক। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য, ঢাকার ঘিঞ্জি বস্তি থেকে নিউইয়র্কের আকাশ ছোঁয়া টাওয়ার সব খানেই পড়েছে এ দানবের বিষাক্ত নখর। জাতি-ধর্ম-বর্ণ , লিঙ্গীয় বা বয়সের ভেদ কিছুই যেন বাধা নয় এই দানবের কাছে।

বর্তমান পৃথিবীতে মাদক সেবনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে প্রতি ২০ জনের একজন মানুষ মারা যাচ্ছেন। পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা তো আরো বহুগুন বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে ৩ মিলিয়নের অধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য কেবল এলকোহল দায়ী। পরিকল্পিত ও মানসম্মত সড়কের ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও আমেরিকাতেই এলকোহল সেবক ডাইভারদের গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৩০ জন মানুষ মারা যান। তাহলে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থাটা একটু কল্পনা করুন। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণসহ হাজারো ঘৃণ্য অপরাধে প্রণোদনা যুগিয়ে আসছে এই বিষাক্ত ভাইরাস। ধ্বংস করছে বিবেক, বুদ্ধি ও মনুষ্যত্ব। পৃথিবীকে করছে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। একজন মাদকাসক্ত যেখানে একটি পরিবার বা সমাজের জন্যে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায় সেখানে কেবল বাংলাদেশই বেসরকারি হিসাবে ১.৫ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত। এর সাফারার তো আমাদের প্রত্যহই হতে হচ্ছে। অপরাধ ও নিরাপত্তাহীনতার এক ভুতুড়ে রাজ্যে বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের।

এ পর্যায়ে প্রশ্ন উদয় হতে পারে মাদকের এই ভয়াবহ বিস্তারের পেছনে প্রধানত দায়ী কে? এর জবাবে আমরা একবাক্য বলবো, বিদ্যমান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক জাহেলিয়াত এর জন্য প্রধানত দায়ী। সেক্যুলার লিবারেল সমাজব্যবস্থাই ফুয়েল যোগাচ্ছে মাদকের বিস্তার ও মাদকাসক্ত তৈরিতে। সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনের উদ্দেশ্য যখন সর্বোচ্চ আনন্দ বা ইউটিলিটি খোঁজা, ভালো মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠি হচ্ছে মানুষের প্রবৃত্তি আর অপরাধের সংজ্ঞা যখন অপরের ক্ষতি না করা, তখন কেউ নিজে নিজে মাদক গ্রহণ করলে অপরাধ কোথায়! সে তো কারো ক্ষতি করছে না , এটা তো ব্যক্তি স্বাধীনতা! আর লিবারেল রাষ্ট্রের কাজ হলো নাগরিকের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এর সাথে নৈতিকতাহীন সেক্যুলার রাষ্ট্রের পুঁজির লোভ তো আছেই। ফলশ্রæতিতে পৃথিবীর সকল সেক্যুলার রাষ্ট্রেই মদ বৈধ। তবে অবশ্যই লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে হবে যাতে মদের দামে রাষ্ট্র ভাগ পেতে পারে। মদ বৈধ হলে অন্যান্য মাদক কেন নিষিদ্ধ থাকবে? এ প্রশ্নও এখন উঠতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক দেশে গাঁজাও বৈধ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে অন্যান্য মাদক বৈধ করা হচ্ছে বা কোন কোন মাদককে মাদকের তালিকাতেই লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে না। যেমন: ‘ড্যান্ডি’ বাংলাদেশের আইনে মাদকের মধ্যেই পড়ে না।

রাষ্ট্রের যেখানে কাজ হওয়া উচিত ছিলো সবধরনের ক্ষতিকর উপকরণ ধ্বংস সাধন কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো পুঁজিবাদী লিবারেল রাষ্ট্রই স্বয়ং নানা প্রকার মাদকের বৈধতা দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য কাগজে কলমে নিষিদ্ধ হলেও মাদক ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের অর্থের কাছে বিক্রি হচ্ছে সেক্যুলার রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বাহিনী। কোন কোন দেশ তো মাদক পাচারকেই দেশের আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে গ্রহণ করছে। উদাহরণ হিসেবে মেক্সিকো বা মায়ানমার সেনাবাহিনীর কথা বলা যায়। কিছু মাদক নিষিদ্ধ করা করা হলেও একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ক্ষতিকর অন্যান্য মাদক বৈধ করা হয় ন্যায় ও যুক্তির তোয়াক্কা না করে।

নেশাজাতীয় দ্রব্য চারপ্রকারে ভাগ করা হয়:
১। হেলুসিনোজেন: এমনসব দ্রব্য যা দৃষ্টি ও শ্রবণে বিভ্রম তৈরি করে থাকে।
২। ইনএব্রিয়েন্ট বা নেশাদ্রব্য: এলকোহল ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য এই গ্রæপের অন্তর্ভুক্ত।
৩।হিপনোটিক্স: ঘুম ঘুম ও অবশতা সৃষ্টিকারী দ্রব্য, যেমন, আফিম ও অন্যান্য নার্কোটিক দ্রব্য।
৪। স্টিমিউল্যান্ট বা চেতনাউদ্দীপক দ্রব্য: কোকেইন, মরফিম ইত্যাদি।

মদ, গাঁজা হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ইত্যাদিতে প্রায় এই চারধরনের প্রতিক্রিয়াই লভ্য। এরা চেতনাকে উদ্দীপিত করে, চেতনাকে নাশ করে, দৃষ্টি ও শ্রবণে বিভ্রম আনে এবং সাথে মনে ও চৈতন্যে এক মিথ্যা ও সাময়িক ইন্দ্রিয়াতুর আনন্দের আবেশ ও ঘোর তৈরি করে। এগুলোর সেবন হিত ও অহিতের জ্ঞানকে লুপ্ত করে এবং এক মায়াময় মিথ্যা আবেশে সেবনকারীকে নিমজ্জিত করে নিজ নিজ কল্পনা ও শরীরের আবেষ্টনীতে। এক্ষেত্রে একটি মাদক নিষিদ্ধ করে অপরটি বৈধ করা কোন যুক্তির মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে না।

মাদক সমস্যা নিরসনে সেক্যুলার সমাজের ঠুনকো দেশপ্রেম আর দুচারটে নীতি কথায় নগদ ডোপামিনের ঝড় তোলা নেশায় দমন সম্ভব হচ্ছে না, থামানো যাচ্ছে না সাময়িক তীব্র উন্মাদনার আসত্তি। জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা শিক্ষা দিতে সামর্থ্যহীন ভোগবাদি শিক্ষা কারিকুলামের তরুণ-তরুণীদের দেখা যাচ্ছে দল বেঁধে সীসাবারে সুখ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় মশগুল হতে। জাহেলী কাব্যে সাকি ও সুরার যে উচ্ছ¡ল প্রশংসার ধারা তৈরি হয়েছিলো তা নব্য আধুনিক জাহেলিয়াতেও অব্যাহত আছে। আধুনিক কবি জীবনানন্দকে তাই লিখতে দেখা যায়, “রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ”।

পশ্চিমা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও কম পারঙ্গমতা দেখাচ্ছে না এ কাজে। এসকল অপসংস্কৃতি প্রচারেও মূল সহযোগিতা করছে আমাদের প্রিয় লিবারেল বিশ্বব্যবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ সমস্যার সমাধান কী আদৌও সম্ভব? হ্যাঁ সমাধান তো অবশ্যই আছে কিন্তু এর সমাধান আমাদের বিদ্যমান সেক্যুলার বিশ্বব্যবস্থার কাছে নেই। লিবারেলিজম কিংবা ডেমোক্রেসির কাছেও নেই এর থেকে উত্তরণের উপায়। যেমনটা ছিলো না গ্রীকদের মদের দেবতা ডায়োনিসাস বা রোমানদের মদের দেবতা বাক্কাসের পূজারীদের কাছে। তারা মানব সভ্যতা ধ্বংসের নিয়ামক মদকে তাদের জীবন ও অর্থনীতির চালিকা হিসেবে মনে করে এই কাল্পনিক মদের দেবতার অর্চনা শুরু করেছিলো,[৯] আর নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে এনেছিলো। হিন্দুইজম ,বিকৃত খ্রীষ্টান ও ইহুদীধর্মও প্রায়শই মদ্য পানকে “রিচুয়াল” হিসেবে উদযাপন করেছে। প্যাগানিজমেও মদ বা ওয়াইনকে গডের কাছাকাছি যাবার উপায় হিসেবে গণ্য করতো। এমনকি, যে পাশ্চাত্য সভ্যতা যুক্তি ও বুদ্ধির জয়গান করে তারাও বুদ্ধিলোপকারী এই নেশাদ্রব্যকে নিষিদ্ধ করেনি। পশ্চিমা বিজ্ঞান অতিরিক্ত মদ্যপান বা নেশাদ্রব্যের ক্ষতির দিক উল্লেখ করলেও পরিমিত পানকে অনুমোদন দিয়েছে। ফলে, পশ্চিমে উচ্চবিত্ত, নিন্ম বা মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে মদ্যপান এক স্বসংস্কৃতির মর্যাদা লাভ করেছে। অপরদিকে ইসলামে যা কিছু মানুষকে আল্লাহ তায়ালাকে ভুলিয়ে দেয় ও আত্মঅসচেতন করে তুলে তা-ই নিষিদ্ধ। সুতরাং, আকলমান্দ ও সচেতন যুক্তিশীল থাকাকে ইসলাম ছাড়া আর কেউ এতোটা ভারসাম্যপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। তাই এই গ্রিক ও রোমান সভ্যতার উত্তরাধিকারী হালের খায়েসাতবাদী মানবসৃষ্ট কোন ডগমার পক্ষেও সম্ভব নয় মাদকের নীল ছোবল থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করা।

মাদক সমস্যা সমাধানে প্রথমে প্রয়োজন হবে মানুষকে তার প্রকৃত পরিচয়ের সন্ধান দেয়া। সুপরিকল্পিত এই ধরনীতে একজন মানুষের দায়িত্ব কী? শুধুই খেয়ে-পড়ে-খেটে বেঁচে থাকা নাকি তার আর কোন মহান দায়িত্ব রয়েছে?

জীবনের অর্থই বা কী? মানুষ মরে গেলেই পচে সব শেষ নাকি কৃতকর্মের জন্য বিচারের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে? মানুষের জীবন কী ইহলোকেই সীমাবদ্ধ নাকি প্রতিটি মানুষ ক্ষুদ্র ইহজীবন থেকে মহাজীবনের পথযাত্রী? ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের চূড়ান্ত মানদন্ড কে নির্ধারণ করবে? পাঁচ মিনিট পর নিজের লাইফে কি ঘটতে যাচ্ছে বলতে না পারা মানুষ নাকি এমন সত্ত¡া যিনিই কালের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক, যার ইশারায় সকল সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়?

প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমরা আমাদের রবের কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি কেবল আমাদের পৃথিবীতেই পাঠাননি বরং আমাদের উপর অনুগ্রহ করে জীবন পরিচালনার গাইডলাইনও দিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো মহাগ্রন্থ আল কোরআন, দিয়েছেন অনুসরণীয় আদর্শ তথা নবী-রাসূল। আমরা জানতে পেরেছি একটি নৈতিক সভ্যতা বিনির্মাণের রূপরেখা ও খেলাফত তথা কল্যাণময় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে। আর খিলাফত ব্যবস্থাই পারে যাবতীয় কদর্যতা মুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ, কল্যাণময় একটি বিশ্ব উপহার দিতে।

খিলাফত ব্যবস্থায় সব কিছু নির্ধারণের চূড়ান্ত মানদন্ড হচ্ছে চির অপরিবর্তনীয় আল-কোরআন। খিলাফাহ’তে আল্লাহ তায়ালা বান্দার কল্যাণের জন্য যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন তা হারাম(নিষিদ্ধ)। আর কোন শক্তি নেই তা পরিবর্তন করার, পুঁজিপতির স্বার্থ, মধ্যবিত্তের ভোট, কোন সাম্রাজ্যের ইচ্ছে বা প্রবৃত্তির চাহিদা কোন কিছুই হারামকে হালাল করতে পারে না। অকল্যাণকর কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এখানেই লিবারেল দর্শনের থেকে খিলাফাহ’র দর্শনের বড় পার্থক্য। মদ বা আনুসাঙ্গিক মাদক খিলাফাহ’তে সর্বদাই নিষিদ্ধ । নিষিদ্ধ মানে নিষিদ্ধ। উৎপাদন, বিপণন, আমদানি, প্রচার, সেবন সবই নিষিদ্ধ। অর্থাৎ জনগণ যাতে মাদকের ছোবল থেকে বাঁচতে পারে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া খিলাফাহ’র অন্যতম দায়িত্ব। শুধু নিষিদ্ধ করেই খিলাফাহ রাষ্ট্রের কাজ শেষ নয়, প্রতিটি মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া, এই ইহজীবন যে মহাজীবনের জন্য পরীক্ষা এ বোধ জাগ্রত করা, নাগরিকদের আত্মশুদ্ধিতে কাজ করা। অর্থাৎ খিলাফাহ রাষ্ট্রে মানুষ প্রকৃত আত্মিক প্রশান্তির দিক্ষা প্রাপ্ত হন। তাই নাগরিকরাই যাবতীয় নেশাদ্রব্যকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে যেমনটা ১৪’শত বছর আগে মক্কায় মদ নিষিদ্ধের আয়াত শুনে উম্মাহর প্রথম প্রজন্ম করেছিলেন।

খিলাফাহ ‘সেক্যুলার’ রাষ্ট্রের মতো কেবল বুলেটের জোর খাটিয়ে অপরাধ দমনের চেষ্টা করে না, অন্যায়ের পথ বন্ধের পাশাপাশি একটি উন্নত আদর্শের সন্ধান দেয়, যা মানুষকে কুপথ থেকে সুপথে পরিচালিত করে। এরপরও যদি কেউ প্রকাশ্য মাদক সেবনের ধৃষ্টতা দেখায় , তখন সুস্পষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারিক ভাবে প্রকাশ্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। অপরাধী যেই হোক আইনের চোখে সবাই সমান, শাসক চাইলেই কারও হদ (পড়ুন সাজা) মওকুফ করতে পারে না , এখানে স্বাজনপ্রীতির কোন স্থান নেই। প্রকাশ্য বিচার ও দন্ডবিধি কার্যকর হওয়ার কারণে দোদুল্যমান নাগরিকরা দুষ্কর্ম থেকে সাবধান হন এবং উত্তম মানুষ হবার জন্য প্রেরণা পান। ‘আমর বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজে অনুপ্রেরণা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের মাধ্যমে খিলাফাহ খুব সুন্দরভাবেই মাদকমুক্ত নিরাপদ সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারে। আর খিলাফাহ কোন ইউটোপিয়ান ধারণাও নয় , এটি বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণিত কল্যাণের শাসনব্যবস্থা, আর রহমানের বাতলে দেয়া শাসনব্যবস্থা, খোলাফায়ে রাশেদীনের উজ্জ্বল ইতিহাস তো আমাদের সম্মুখেই আছে।

ভাই আমার, আপনার জীবন মূল্যবান। মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অতি উত্তমভাবে সৃষ্টি করেছেন। আপনি নিজেও জানেন আপনি যে কাজটি করছেন তা আপনার জন্য ক্ষতিকর, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানেই ক্ষতিকর। আপনার জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব আপনার। প্লিজ ভাই, আপনার জীবন এভাবে নষ্ট করে ফেলবেন না। পৃথিবী হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্র, এখানে আমাকে, আপনাকে, সবাইকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি বড় পাপী, তাই আপনার পাপের ক্ষমা নেই, আপনার জন্য জাহান্নাম অবধারিত! তাহলে বলবো ভাই আপনি ভুল ধারণার মধ্যে আছেন, দয়াময় আল্লাহর দয়া সম্পর্কে আপনি এখনো পুরোপুরি অবগত নন। আপনি পূর্বে যতই গোনাহ করুন না কেন পরিপূর্ণ তাওবাহ করে রবের পথে ফিরে আসলে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। আল্লাহ তায়ালা তো শিরকের মতো বড় গোনাহও তাওবাহ করলে ক্ষমা করে দেন। সুবাহানাল্লাহ। সে আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবে না কীভাবে হতে পারে ভাই ! মাদকের পথ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসার হাজারো উদাহরণ দেয়া যাবে। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ পারলে আপনি কেন পারবেন না ভাই? কেবল প্রয়োজন আপনার সদিচ্ছার, একটি দৃঢ় সীদ্ধান্তের।

আপনি মাদক থেকে ফিরে আসতে নিন্মের কাজ গুলো করতে পারেন:
১) প্রথমেই আপনাকে মাদক ত্যাগের দৃঢ় সীদ্ধান্ত নিতে হবে ও তওবাহ করার পাশাপাশি আল্লাহ সাহায্য কামনা করতে হবে, মানুষ চেষ্টা করলে আল্লাহ তায়ালা অনেককে এভারেস্ট বিজয়ীয়েরও সুযোগ দেন, আর আপনি মাদক ত্যাগ করতে পারবেন না, তা হতেই পারে না।
২) আপনার মাদকাসক্ত বন্ধুদের সার্কেল অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
৩) সামায়িক সময়ের জন্য নিজ অবস্থান ত্যাগ করা। অর্থাৎ আপনার কোন ধার্মিক রিলেটিভ(কাজিন, বন্ধুসুলভ মামা ইত্যাদি) থাকলে পারিবারিক আলোচনা সাপেক্ষে তাঁর বাসায় চলে যাওয়া যেতে পারে।
৪) ছাত্র হয়ে থাকলে যে মেসের সকল সদস্যের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক এমন কোন মেসে উঠা। তখন নতুন একটি দীনি সার্কেল তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ। ছাত্র ও অছাত্র সবাই সম্ভব হলে তাবলীগের এক চিল্লায় চলে যাওয়া। মাদকের নেশা ছাড়াতে এটা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী হয়।
৫) কোরআন পড়া ও বেশি বেশি কোরআন শ্রবণ করা।
৭) ইসলামী আলোচনা শোনা, ইসলামী বই অধ্যায়ন করা। বিশেষভাবে পরকালীন জীবন, কবর, হাশর, মিজান, জান্নাত, জাহান্নাম, নবীজী ও সাহাবাদের জীবনী কেন্দ্রীক আলোচনা অধিক শোনা ।
৮) মাদকাসক্তের সাথে চলাফেরা করতে হয় এমন কর্মে যুক্ত থাকলে তা পরিত্যাগ করা।
৯) মসজিদে ব্যাপক সময় দেয়া ও আলেম ওলামাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং ব্যাপক দ্বীনিবন্ধু তৈরি করা।
১০) বাবা মায়ের দোয়া নেয়া।
১১) অবস্থানকালীন এলাকায় সক্রিয় কোন দাওয়াতি সংগঠনে যুক্ত হওয়া।

উপরের কথাগুলো ভাইদের উদ্দেশ্যে বলা হলেও ম্যাক্সিমাম পয়েন্ট বোনদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।

আমাদের করণীয়: মাদক নির্মূলে আমাদের ইসলাম অনুরাগী যুবসমাজের দায়বদ্ধতা অনেক। বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মের পক্ষে নেয়া সম্ভব। তারমধ্যে অন্যতম হলো মসজিদ কেন্দ্রীক দীনি কার্যক্রম স¤প্রসারণ। বিভিন্ন দাওয়াতি ইভেন্ট আয়োজনের পাশাপাশি যার যার সমাজের মুরব্বিদের সাথে মাদক সমস্যা হ্রাস করার উপায় নিয়ে মাশোয়ারা করা, মহল্লায় কোন তরুণ মাদকাসক্তদের সাথে চলাফেরা করলে বা মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মুরব্বিদের নেতৃত্বে ও যুবকদের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে মহল্লার কোথাও যাতে মাদক বিক্রি বা মাদকের আসর না বসতে পারে সে বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা। বিভিন্ন রকম হালাল ও আকর্ষণীয় ইসলামী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যুবসমাজকে ভালো কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।

সর্বোপরি মাদক, অশ্লীলতা, যিনা-ব্যভিচার, পরকিয়া, ধর্ষণসহ শত শত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে লিবারেল সেকুলার সমাজব্যবস্থার নামক নব্য জাহেলিয়াতের পতন করে খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আধুনিক জাহেলিয়াতের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রতিরোধ তৎপরতা বেগবান করতে হবে। এজন্য আমাদের প্রয়োজন হবে পরিকল্পিতভাবে আসু ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে আগানো। ফিরিঙ্গি সভ্যতা আমাদের শত অন্যায়ের পাশাপাশি মাদকময় পৃথিবী উপহার দিয়েছে, নৈতিকতার প্রশ্নে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছে এই সভ্যতা। কেবল ইসলামী সভ্যতাই পারে এই জাহেলিয়াতের গতিরোধ করতে, নৈতিক সমৃদ্ধ কল্যাণময় বিশ্ব উপহার দিতে। ইসলাম হচ্ছে আলো, ইসলামের বিপরীতটাই হলো অন্ধকার তথা জাহেলিয়াত। কেবল ইসলামই পারে যুব সমস্যাসহ যাবতীয় সমস্যা দূর করতে, মানবজাতিকে কল্যাণের পথ দেখাতে। তাই কল্যাণের জন্য আমাদের ইসলামের মধ্যেই প্রবেশ করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট-গবেষক, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।

 

 

 

 

Share





Comments are Closed