Main Menu

ইসলামে বই পড়ার গুরুত্ব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: জ্ঞানার্জনের মাধ্যম বই। বই পাঠ ছাড়া মানুষ সত্যিকারার্থে সফলতার আলোয় আলোকিত হতে পারে না। জগদ্বিখ্যাত সফল মানুষরা বই পড়েই আলোকিত হয়েছেন। ইসলামে পাঠের গুরুত্ব অনেক। পবিত্র কোরআন অবতরণের প্রথম বাণী ‘পড়’।

‘বই’ দুই বর্ণের এই শব্দটি এসেছে আরবি ‘ওহি’ শব্দ থেকে। আরবি ‘ওয়াও’ হরফের বাংলা উচ্চারণ হয় ‘ব’। ‘ওহি’র বাংলা উচ্চারণ হয় ‘বহি’। ধীরে ধীরে ভাষার পরিবর্তনে ‘বহি’টি ‘বই’ রূপ ধারণ করেছে। মানে ওহি থেকে বহি; বহি থেকে বই। এভাবে বইয়ের সঙ্গে ওহির জ্ঞানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত ‘ওহি’ পবিত্র কোরআনের প্রথম পাঁচ আয়াতই হচ্ছে পাঠ করা কিংবা জ্ঞানার্জন সম্পর্কে। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ূন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন…’ (সুরা আলাক)। এর মধ্যে প্রথম বাণীটিই হলো ‘ইকরা-পড়’। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের অন্তত ৯২ জায়গায় জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রসঙ্গ এনেছেন। ‘আল-কোরআন’ শব্দটির একটি অর্থও ‘অধ্যয়ন’।

জ্ঞানই মানুষকে আল্লাহভীরু করে তোলে। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির : ২৮)। পবিত্র কোরআনে যেসব দৃষ্টান্ত রয়েছে, তা অনুধাবনের জন্যও জ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর এসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য উপস্থাপন করি, আর জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৩)। যে জানে এবং যে জানে না এই দুই ব্যক্তি সমান হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা যুমার : ৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ)

যারা জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ (সুরা মুজাদালাহ : ১১)। জ্ঞান অন্বেষণ করা এতই মর্যাদাপূর্ণ যে, ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য আকাশ ও জমিনের সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দ্বীনি জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য জগতের সব কিছুই (আল্লাহ তায়ালার দরবারে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মাছও। (আবু দাউদ, তিরমিজি)। ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, কোনো বিষয়ে কিছু বলা এবং আমল করার আগে সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। কেননা আল্লাহ তায়ালা সুরা মুহাম্মদের ১৯ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘আর জেনে নাও, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ এখানে ‘জেনে নাও’ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ‘জ্ঞানার্জন’ বুঝিয়েছেন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হয় বই পাঠের মাধ্যমে।

পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাম্য। যেমন চিকিৎসা, গণিত, কৃষি, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি। গোটা জনপদে যদি এই জ্ঞানের পারদর্শী কেউ না থাকে, তাহলে সবাই কষ্টে পতিত হবে। পক্ষান্তরে যে জ্ঞান মানুষকে অকল্যাণের দিকে নিয়ে যায়, তা চর্চা করা হারাম। যেমন ইসলামবিরোধী প্রাচীন ও আধুনিক দর্শন, কুফরি সাহিত্য ইত্যাদি। তদ্রুপ অকল্যাণকর ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় চর্চা করাও নিষিদ্ধ। (ইহইয়াউ উলুমিদদীন : ১/২৯-৩০)

এই বিশ্ব জাহানের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস ও সভ্যতা, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার, জ্ঞানী ব্যক্তিদের চিন্তাধারা ও জীবন দর্শন ইত্যাদি আমরা বই পড়ার মাধ্যমেই জানতে পারি। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি এমন যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে নিয়মিত বই পড়তে হয়। বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। মস্তিষ্ককে সচল রাখা যায়। মানসিক উদ্দীপনা বাড়ে। মানসিক চাপ কমিয়ে প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে। শব্দভান্ডার তৈরিতে সাহায্য করে। স্মৃতিকে শক্তিশালী এবং উন্নত করে। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। লেখক থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ও সেতুবন্ধন তৈরি হয়। কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ে। নতুন বিষয় জানা ও আবিষ্কার করা যায়। মনোযোগ বাড়ায়। উন্নত মানুষ গঠনে সহায়তা করে। বই তার পাঠককে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। ভবিষ্যতের উত্তম কর্ম নির্ণয় করা যায়। মনকে সুস্থ ও প্রফুল্ল রাখা যায় এবং বিনোদিত হওয়া যায় এবং নতুন কোনো ভাষা শিখতেও বই পড়ার বিকল্প নেই।

পাঠ একজন মানুষকে পরিপূর্ণ করে, কথা একজন মানুষকে চটপটে করে এবং লেখালেখি একজন মানুষকে যথাযথ করে। তাই যে লেখালেখি করে না, তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। যে কথার চর্চা কম করে, তার প্রজ্ঞায় ভাটা পড়ে। আর যে বই কম পড়ে, জানার ভাব দেখানোর জন্য তার ধূর্ততার প্রয়োজন হয়। আর ইতিহাস-পাঠ মানুষকে জ্ঞানী করে, কবিতা-পাঠ বুদ্ধিদীপ্ত করে, গণিতচর্চা যুক্তিবোধকে শানিত করে, প্রাকৃতিক দর্শন নৈতিকতার ভিত্তি সুদৃঢ় করে। মোটকথা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বই পড়ার এখনও কোনো বিকল্প নেই।

পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী যেহেতু ইকরা বা পড়, এ আদেশের প্রাথমিক পঠিতব্য বিষয় হলো আল কোরআন। অতএব কোরআনই হবে আমাদের মূল ও কেন্দ্রীয় পাঠ্যসূচি। কোরআনকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য হাদিসের পাঠও জরুরি। পাশাপাশি ইসলাম সম্পর্কিত অন্যান্য বইপত্রও পড়া চাই সাধ্যমতো। তবে যে বই আমাদের আকিদা-বিশ্বাস নষ্ট করে, চরিত্র ধ্বংস করে, সে ধরনের বই পড়া উচিত নয়। বরং চরিত্র গঠনমূলক ও আলোকিত মানুষ গড়ার বই-ই পড়া চাই।

 

 

Share





Comments are Closed