Main Menu

‘অটোপাস’ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে

মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী: অটোপাস আর প্রমোশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সরকার দ্বি-মুখী আচরণ করছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। দেশে অফিস-আদালত, ‘গার্মেন্টস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, শপিংমল সবই খোলা আছে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেনো? প্রকৃত অর্থে সরকারের মধ্যে থাকা বৈষম্যের নীতিই এর মূল কারণ। সরকারে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশের সন্তান বিদেশে থাকে। যাদের পরিবার-পরিজনের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু সমস্যা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তাদের। এদের প্রতি তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। সা¤প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতি ও ঘরে ঘরে অনলাইন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা এসেছে। এখন যেন সমস্ত পৃথিবী ঝুঁকে পড়েছে ইন্টারনেটে। এর প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি কোমলমতি শিশুরাও। এই ইন্টারনেট বধ করেছে তাদের শৈশবকেও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। যেটি আমাদের দেশের শিশুদের মধ্যেও সা¤প্রতিক সময় অতিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন কি কোচিংও বন্ধ থাকায় শিশুকিশোররা ইউটিউব, ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারের মতো অ্যাপসগুলো তাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে।

পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ছাড়া বন্দী বন্দি জীবনযাপন করছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে, বাল্য বিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেকে মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে, মাদকাসক্ত ও কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। করোনাকালে যৌন সহিংসতা, নিপীড়ন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা জ্ঞান চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে আগামী প্রজন্ম। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী করোনাকালে গত ১৫ মাসে ১৫১ জন শিক্ষার্থী মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। তাই, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাত্র ও শিক্ষকদের করোনার টিকা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে হবে। দীর্ঘ দিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এ সময়ে বাহিরে ঘুরাঘুরি করছে, টিভি দেখে ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সময় ব্যয় করছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খারাপ অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীদের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে দেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী ‘গৃহবন্দি’ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। সংক্রমণ অনেকটা কমে আসায় এবং করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় অবশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতির কথা শুনা গেলেও সহসাই চালু হচ্ছেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় আছে কিন্ডারগার্টেনগুলো। সারা দেশের ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেনে প্রায় ৮০ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। সরকারি প্রাথমিকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তার প্রায় অর্ধেকসংখ্যক পড়াশোনা করে কিন্ডারগার্টেনে। কাজেই এ ব্যাপারে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। দ্রুত স্কুলগুলো খুলে না দিলে কিন্ডারগার্টেনেরও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। গত বছরের ১৯-২৮ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৫০৯ জন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্তি¡ক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ হালকা, ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ মধ্যম, ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ মাঝারিভাবে মারাত্মক এবং ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। গত বছরের ২৫ এপ্রিল-৯ মে পর্যন্ত ১৫ বছরের কম বয়সী ৩৮৪ জনের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ শিশু অতি অল্প মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে, ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ অল্পভাবে, ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ পরিমিত মাঝারিভাবে, ৭ দশমিক ২ শতাংশ শিশু মারাত্মকভাবে অস্থিরতায় ভুগছে।

সর্বশেষ জাতীয় জরিপে দেখা যায় দেশে প্রায় ১ কোটি ৭৭ লাখ মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত ১৪ বছরে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগী বেড়েছে ৫৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৮ জন। করোনাকালে এ পরিস্থিতি আরও ব্যাপক রূপ নিয়েছে। জীবিকার সংকট, ভয়, আতঙ্ক, চোখের সামনে বীভৎস মৃত্যু দেখা, নৃশংসতা আমাদের মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ রকম ঘটনা আগেও ঘটত কিন্তু ইদানীং আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বতীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়. দ্রুতক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একই মত দিয়েছেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তথা মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বেঁধে দেওয়া শর্তাবলি পালন করে দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘স্কুল রি-ওপেনিং প্ল্যান’ তৈরি করেছে। এতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, স্কুল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম।

গত ৮ মার্চ ২০২০ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর গত ১৭ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গত বছর শর্তসাপেক্ষে কওমি মাদরাসা সমূহ চালু রাখার অনুমতি দিলেও চলতি বছর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ রয়েছে কওমি মাদরাসা। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে । গত ১২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন হলো-বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় তবে কি আজীবন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে?

লেখক: সাধারণ সম্পাদক-জালালাবাদ লেখক ফোরাম।

 

Share





Related News

Comments are Closed