Main Menu

একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ অপতথ্য প্রচার রোধে করণীয়

আশরাফুল ইসলাম ফয়সাল: একদা জনৈক ব্যক্তি বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কাছে এসে বলল, ‘সক্রেটিস, তুমি কি জানো এইমাত্র আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে কি শুনে এলাম? সক্রেটিস বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়াও, তুমি আমার বন্ধুকে নিয়ে ঘটনাটি বলার আগে আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। আমি এর নাম দিয়েছি ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’। প্রথম প্রশ্নটি সত্য মিথ্যা নিয়ে, তুমি কি নিশ্চিত তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা নির্ভেজাল সত্য? লোকটি উত্তর দিল, না, আমি জানি না এটা সত্য কিনা, আসলে আমি একজনের কাছে শুনছে। ‘ঠিক আছ’ সক্রেটিস আবার বলল, ‘তাহলে তুমি নিশ্চিত না যে তুমি যা বলবে তা সত্য। এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি আমার বন্ধু সম্বন্ধে ভালো কিছু বলব? ‘উম, নাহ, আসলে খারাপ কিছুই…।’ সক্রেটিস বললেন, ‘তাহলে তুমি আমার বন্ধু সর্ম্পকে আমাকে খারাপ কিছু বলতে চাও এবং তুমি নিশ্চিত নও যে তা সত্যি কিনা। ‘ঠিক আছ’ এখনও তৃতীয় প্রশ্ন বাকি, তুমি তৃতীয় পরীক্ষায় পাশ করলে আমাকে কথাটি বলতে পারো। তৃতীয় প্রশ্নটি হল, তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা কি আমার জন্য উপকারী? লোকটি উত্তর দিল, ‘না, আসলে তোমার জন্য তা উপকারী নয়।’ এবার সক্রেটিস শেষ কথাটি বললেন, ‘যদি তুমি আমাকে যা বলতে চাও তা সত্যও নয়, ভালো কিছুও নয় এবং আমার জন্য উপকারীও না হয়, তবে আমাকে বলে কী লাভ!’ এ ঘটনাটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হল, কোনো একটি তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে যদি আমরা তা ছড়াতে থাকি তবে সেটি যেমন আত্মঘাতী হতে পারে, তেমনি সমাজ-রাষ্ট্ররে জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে । এ ক্ষেত্রে কোনো একটি ঘটনা বা তথ্যকে বিশ্বাস করার আগে আমরা তা সক্রেটিসের দর্শনভত্তিকি ধারণার মতো ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ করে নিতে পারি।

সারাবিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তরি অভূতর্পূব বিকাশ ও নতুন নতুন যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের আবিষ্কারের ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ প্রক্রিয়া এখন অনকে সহজ। যোগাযোগ তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান যে বিশ্ব গ্রামের (Global Village) কথা বলেছিলেন তা আজ প্রকৃতপক্ষইে মানুষের হাতের মুঠোয়। সীমাহীন অভিগম্যতা আমাদের জীবনকে যেমন করে তুলেছে সহজ তেমনি বাড়িয়েছে নতুন নতুন ঝুঁকি। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে তথ্যের অতি প্রবাহ বা অত্যধিক শেয়ারিং এর বিষয়টিকে ইউনসেকো উল্লখে করছে তথ্য বৈকল্য (Information Disorder) হিসেবে।

অপতথ্য ও ভুল তথ্য শব্দ দুটো বিভিন্ন সময় একই অর্থে ব্যাখ্যা করা হলেও দুটো শব্দের মধ্যে রয়েছে অর্থগত ব্যাপক পার্থক্য। অপতথ্য মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারিত বিভ্রান্তিকর বা পক্ষপাতমূলক তথ্যই অপতথ্য। অন্যদিকে ভুল তথ্য হলো এমন একপ্রকার তথ্য, যা ভুল কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি তৈরির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয় না। ভুল তথ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন আকারে ছড়ালেও অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি জড়িত থাকে, যার ফলে অপতথ্য প্রতিহত করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমান প্রজন্ম একটি ডিজিটাল ব্যক্তিসত্তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপতথ্যকে কাজে লাগানো বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রমের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন কর্মশালাগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও সাইবার সুরক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত নীতির ওপর ভিত্তি করে জনসাধারণের মধ্যে গুজবের নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সাইবার সিকিউরিটি আইনের বিভিন্ন ধারায় অপতথ্য প্রচারের শাস্তি উল্লেখ করা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ আইনের মাধ্যমে অপতথ্য সম্পর্কিত সকল প্রকার কর্মকাণ্ডকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন নাম দিয়ে যে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, সেগুলোর অবস্থান শনাক্ত করে দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে সাইবার ক্রাইম যে একটি অপরাধ, এটি করলে যে আইনের আওতায় পড়তে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে- এ বিষয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

গণযোগাযোগ তাত্ত্বিকরা এ বিষয়টি মোকাবিলার জন্য যাচাইকরণ বা Fact Checking এর ওপর জোর দিচ্ছেন। তাই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াকে যুক্তিসঙ্গত করা এবং সংঘাত-সহিংতাকে উসকে না দেওয়ার জন্য যাচাইকরণ তীব্র জরুরি। নিজেকে নিরাপদ রাখতে, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সবারই উচিত যাচাইকরণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে যাচাইকরণ বা Fact Checking এ বিনিযোগ করা উচিত যা জাল খবর শনাক্ত করে অনলাইন জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

ভুয়া খবর এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পেশাদার সাংবাদিকতার দৃঢ় নীতির প্রচার, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে সমর্থন করা, ভুয়া খবরের জন্য আর্থিক প্রণোদনা হ্রাস করা এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার উন্নতি করা।
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, সিলেট কর্তৃক আয়োজিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অপতথ্য মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী তাঁর কিনোট বক্তব্যে ফেক নিউজ ছড়ানো রোধ করার জন্য- সমালোচনামূলক চিন্তা ও বিশ্লেষণী দক্ষতা; মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি; ভিন্ন মতকে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা; দায়িত্বশীল শেয়ারিং উৎসাহিত করা; কমিউনিটির সকলের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা; নৈতিক ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রচার; প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের (কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম) ব্যবহার; ভারসাম্য বজায়ের মত সাতটি কার্যকর কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে জড়িত। সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবধ। আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের মাধ্যমে এ বিষয়গুলোর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, অপতথ্য রোধে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করা আমাদের উদ্দেশ্য না। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘তথ্য অধিকার আইন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি বলেন,- ‘আমাদের উদ্দেশ্য সাংবাদিকতা থাকবে, গণমাধ্যম থাকবে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে, মুক্ত সাংবাদিকতা থাকবে। সরকার ও কর্তৃপক্ষের ভুল- ভ্রান্তি থাকলে, ব্যর্থতা থাকলে তার সমালোচনাও হবে। কারণ তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং গঠনমূলক সমালোচনা যেমন গণতন্ত্রের জন্য, একটি দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য।’

জ্ঞাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে তথ্যের গুরুত্ব ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার। তথ্য প্রযুক্তির এ ক্রান্তিকালে অপতথ্য মোকাবিলার এ লড়াইয়ে সরকার, পেশাদার গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ একসঙ্গে অংশীদার হয়ে কাজ করতে হবে। – পিআইিড ফিচার

Share





Comments are Closed