পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধে করণীয়
মো. ফখরুল ইসলাম: দুই বছরের শিশু আদনানকে বাড়ির উঠানে খেলায় বসিয়ে রেখে তার মা সাবিনা খাতুন রান্নাঘরে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করছিলেন। শিশুটির বাবা সোহাগ মিয়া ব্যস্ত ছিলেন কৃষি কাজে। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আদনানকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। একপর্যায়ে বাড়ির সামনের পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুটির ভাসমান মরদেহ। গত বুধবার নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের দিগর সহিলহাটি গ্রামে ঘটনাটি ঘটে। গত বছরের ১১ জুলাই নেত্রকোনার মদনের মাঘান ইউনিয়নের রামদাসখিলা গ্রামে চার বছরের শিশু হাসাইন ও দুই বছরের তাসলিমাকে দুপুরের খাবার দিয়ে তাদের বাবা শফিকুল ইসলাম ও মা খোদেজা বাড়ির সামনে গোয়ালঘরে গরুকে খাবার দিতে যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দুই সন্তানকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে বাড়ির পেছনে নদী থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করেন। শুধু আদনান, হাসাইন ও তাসলিমাই নয়, সচেতনতার অভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম অনেক শিশুই পানিতে ডুবে মারা গেছে; যেসব শিশু মারা যায় তাদের বয়স সাধারণত ১৮ মাস থেকে ১১ বছরের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু বেশি হয়। শিশুদের সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান না থাকা, সচেতনতার অভাবে -এ ধরনের দুর্ঘটনার ঘটনা বেশি হয়। তাঁরা আরো বলছেন, পানিতে ডুবে এত শিশুর মৃত্যু সকলকে ভাবিয়ে তুলছে। দুর্ঘটনা প্রবল অঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে পারলে এসব মৃত্যু কমানো সম্ভব।
একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নেত্রকোনায় পানিতে ডুবে গত ৩ বছর ২ মাসে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জনু বুধবার পর্যন্ত অন্তত ২৩৯ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু গত জুলাই ও আগস্টে অন্তত ২১জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বাকি সাত বিভাগের চাইতে সিলেটে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কম হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বর্ষাকাল ও এর আগে-পরের মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর) পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অভিভাবক, প্রতিবেশী ও অন্যান্যদের অসচেতনতায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার খুবই ভয়াবহ। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে তিরাশি শতাংশই শিশু। ২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক চল্লিশ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় আঠারো হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন এবং নয় মাস থেকে চার বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর ঘটনার তেতাল্লিশ শতাংশই পানিতে ডোবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে যে, জলাশয় –বিশেষ করে পুকুর যেখানে আশি শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে যা বসত বাড়ির আঙ্গিনার বিশ মিটারের মধ্যে। কেবল সঠিক দেখাশুনার অভাবের কারণে ষাট শতাংশ শিশুর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে, যে সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন; বাবারা কাজে ঘরের বাইরে এবং বড় ভাই-বোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে থাকেন- তখন এঘটনাগুলো বেশি ঘটে থাকে। সাঁতার না জানা, নানা কুসংস্কার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞানের অভাবে দিন দিন শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। অভিভাবক, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে এ ধরণের দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের যথাযথভাবে সাঁতার শেখালে; কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি করলে; কর্মব্যস্ত অভিভাবকদের শিশুর জন্য ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা এবং বুদ্ধি-ভিত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা করলে- এধরণের মৃত্যু কমে আসবে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে শিশুদের সাঁতার শেখানো খুবই জরুরি। বাড়ির পাশে কোন জলাশয় থাকলে সেটাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। সাঁতার শেখার আগের বয়সেই যেহেতু শিশুদের ডুবে মৃত্যু হচ্ছে; আবার অনেক সময় বালতি, হাড়ির পানিতেও ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। পাঁচ বছরের শিশুদের সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত দেখভাল করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সুপারভিশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এটা করতে হবে মহল্লাভিত্তিক থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। প্রাতিষ্ঠানিক সুপারভিশনের ব্যবস্থা করা গেলে শতকরা আশি শতাংশ; পাঁচ বছর হবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে সাঁতার শেখানো গেলে এবং বিপদ ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ধারণাও তাদের মাঝে বিকশিত করতে পারলে প্রায় নব্বই শতাংশ মৃত্যু ঝুঁকি কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার নয় দশমিক সাত শতাংশ। সেই তুলনায় শহরাঞ্চলে এই হার সাত শতাংশ। একই বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হারের পরই পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারের অবস্থান।
সরকার ইতিমধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এ নিয়ে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি হয়েছে। শিশুদের প্রাণহানি রোধে ৪৫ উপজেলায় ৮ হাজার যত্ন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের কার্যক্রমও পরিচালিত হবে। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) ‘ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ নামে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। তিন বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সহায়তায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশু একাডেমির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
পানিতে ডুবে অকাল মৃত্যু কারো কাম্য নয়। বড় আকারে জনসচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে কাজ করছে, প্রচার-প্রচারণা করছে এবং একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করছে। তবে কেবল সরকারি উদ্যোগে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে শিশুদের নিরাপদ রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাই আসুন সবাই মিলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে সচেতন হই। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ করি। -পিআইডি ফিচার
Related News
পবিত্র রজব মাসের ফজিলত ও ইবাদত
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী: ‘রজব’ হলো আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহের মাস। রজব মাস বান্দার গুনাহ মাফেরRead More
গীবত বা পরনিন্দা মহাপাপ কোরআন ও হাদীসের আলোকে
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী: ‘গীবত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা,Read More
Comments are Closed