Main Menu

ভাষা সংগ্রামে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল : ভাষা সৈনিক রওশন আরা

রেজাউল আম্বিয়া রাজু : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌর শহরের উছলাপাড়ায় ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাষা সংগ্রামী রওশন আরা (বাচ্চু) জন্ম গ্রহন করেন। ছোট বেলা থেকেই পরাধীনতার গ্লানি তাকে কুরে কুরে খেত। তিনি পরিবারের সদস্যদের মুখে শুনেছেন ব্রিটিশদের শোষণ-বঞ্চনার কথা। সেই সাথে শুনেছেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা। আর বাড়িতে মায়ের কন্ঠে মাঝে মধ্যেই শুনতেন ‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি’ এ গানটি। সেই থেকেই তার মনে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা দেখা দিয়েছিল। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের এরকম ইচ্ছা মনে পোষন করা সে সময় রীতিমতো অপরাধ ছিল। মাত্র ৯বছর বয়সে তাকে শিলং পাঠিয়ে দেয়া হয় লেখাপড়া করার জন্য। তার চাচা ছিলেন তৎকালীন কংগ্রেসের একজন সক্রীয় কর্মী। আর দাদা ছিলেন ব্রিটিশদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রওশন আরা গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়তেন দর্শন বিভাগে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। থাকতেন ঢাবির ওমেন্স রেসিডেন্সে, যেটা বর্তমানে এখন রোকেয়া হল। পারিবারিক এবং দাদা-চাচার রাজনৈতিক আবহে তিনি নিজের ভেতরে যে প্রতিবাদের বীজ রোপন করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর সেটি আরও প্রবল আকার ধারন করেছিল। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। দেশ বিভাগের পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা শাসক আর আমরা পূর্ব পাকিস্থানিরা শোষিত। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক কিছুতেই মিল নেই। তিনি বলেন, এমনিতেই সে সময় আমরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা শক্তিশালী ছিলাম না। আর সেই সঙ্গে যদি আমাদের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হয়ে যায় তাহলে আমাদের জাতি হিসেবে অস্তিত্ব থাকবে না। সেই উপলব্ধি থেকেই সবার সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়া। রওশন আরা বাচ্চু স্মৃতিচারন করে বলেন, তৎকালে ছেলেদের সঙ্গে আন্দোলন তো দূরের কথা, লেখাপড়ার নোট নেয়া কিংবা পথে-ঘাটে কথা বলাও নিষিদ্ধ ছিল। কেউ এরকম করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে ১০টাকা জরিমানা করা হতো। এমনকি হুমকি ছিল ছাত্রত্ব বাতিলেরও। ওমেন্স রেসিডেন্সে সে সময় ছাত্রীসংখ্যা ছিল অনেক কম। সকল ছাত্রী বিভিন্ন হলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। আমি ছিলাম সলিমুল­াহ হলের সঙ্গে। সলিমুল­াহ মুসলিম হল ইউনিয়নের একজন সদস্য ছিলাম আমি। সে সময় থেকেই সলিমুল­াহ হল রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তিনি বলেন, সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় মিটিং করেছি আন্দোলন কর্মসূচি ঠিক করার জন্য। তখন আমাদের সবার মনে হয়েছিল যে, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এ আন্দোলন করলে খুব বেশি তা জোরদার হবে না। প্রয়োজন আরও বেশি মানুষ এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। সে লক্ষ্যেই যার যার যেখানে পরিচিত আছে সেখানে তারা জানাতে লাগলেন। এছাড়া নিজে স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীকে বুঝিয়ে এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি। ৪ ফেব্র“য়ারীর পর থেকে সব জেলায়, মহকুমায় ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকে সচেতনতা তৈরী করা হল। এ সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলাম। কারণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল। রওশন আরা বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পাকিস্তান আইন সভায় তোলার জন্য ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি যখন সব প্র¯ু‘তি আমরা নিয়ে ফেলেছি, তখন জারি করা হয় ১৪৪ধারা। এটা শুনে আমাদের সকলের মাধ্যে সোরগোল পড়ে যায়। সেদিন সবার মুখে একটাই পশ্ন ছিল, আমাদের আন্দোলন কি তাহলে ব্যার্থ হয়ে যাবে? একুশে ফেব্র“য়ারী সকালে আমরা এক এক করে ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলাম। মিছিলে গুলি চলল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তাজা অনেক প্রাণ। আর পরের ঘটনা তো সবার’ই জানা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ৫২’র কথা এলে অনেক সংগ্রামীর নামই আসে। তবে তাদের বেশিরভাগ’ই ছেলে। কিন্তু আমরা মেয়রা সে সময় কতটা প্রতিকূল পরিবেশে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম, তা অনেকেই ভূলে গেছেন। ভাষা সংগ্রামে মেয়েদেরও অগ্রনী ভূমিকা ছিল। মেয়ে ভাষা সংগ্রামীদের নাম তেমন একটা উচ্চারিত হয় না বললেই চলে। তাই আমি মনে করি, ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস সঠিকভাবে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। ছেলেদের পাশাপাশি আমাদের মেয়ে সংগ্রামী যারা ছিলেন তাদেরও নাম আসা উচিত।

Share





Related News

Comments are Closed