Main Menu

বিশ্ব বরণ্য ওলী হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনী (রহ.)

কে এম মিনহাজ উদ্দিন : সালাত ও সালাম সেই নবীর উপর যার আগমনের উছিলায় এই অন্ধকার জমিন আলোকিত হয়েছে। অসংখ্য অগণিত রহমত বর্ষিত হউক আউলিয়ায়ে কেরামগনের কবরে যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মহিমায় পাক-ভারত বাংলাদেশ তথা সিলেটের আনাচে-কানাচে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার লাভ করেছে। তাঁদের মধ্যে হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) ছিলেন অন্যতম।
সুলতানুল বাংলা ওলীকুল শিরোমনি পরী ও বীর হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)’র জন্মের সন ও তারিখ সঠিক ভাবে জানা যায় না। শিকড় সন্ধানী লেখক ও গবেষক সৈয়দ মোস্তাফা কামালের মতে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় অবস্থিত সৌন্দর্যের লীলাভূমি ইয়েমেনের ৬৭১ হিজরী বা ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত কোরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কুরাইশী। তিনি একজন বীর পুরুষ খাঁটি ঈমানদার ও ইসলামের মহান সেবক ছিলেন। মাতা সৈয়দা হাসিনা ফাতিমা বিনতে জালালুদ্দিন সুরুখ বোখারী। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) মাতার দিক হতে বোখারী এবং সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। পিতার দিক হইতে ছিলেন কোরাইশ বংশীয়। মাতা-পিতা উভয়েই পরহেজগার মোত্তাকী এবং কোরাইশ বংশের বিখ্যাত ওলী আল্লাহর বংশধর ছিলেন। মাত্র তিন মাস বয়সের সময়ে তিনি তার মাতাকে হারান। এরপর তাঁর লালন পালনের ভার নেন পিতা মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কোরাইশী। যখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর তখন তাঁর পিতা মোহাম্মদ বিন কোরাইশী কোন এক ধর্ম যুদ্ধে নিহত হন। মাতা তো আগেই চলে গিয়েছেন। এবার পিতাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন শিশু হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)। তারপর এতিম শিশু হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) এর পালন পালনের ভার নেন তাঁর মামা ও মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবীর সোহরাওয়ার্দী (রহ:)। তিনি ছিলেন মক্কা শরীফের বিশিষ্ট আলেম ও কামেল ওলী। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) তাঁর মামা ও মুর্শিদের কাছ থেকে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কোরআন, হাদীস, ফেকাহ, তাফসীর, মানতেক ও ইলমে তাছাউফ প্রভৃতি শিক্ষা লাভ করেন।
যখন হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)- এর বয়স ৩০ বছর তখন এক রাত্রে তিনি স্বপ্ন যোগে পূর্ব দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ লাভ করেন। তিনি স্বপ্নের বিষয় মামা ও মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবীর সোহরার্দী (রহ:)-কে অবগত করেন। তাঁর মুর্শিদ তাঁকে হিন্দুস্থানের পূর্বাঞ্চলে গিয়ে ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। প্রাচ্য দেশে যাত্রার প্রাক্কালে মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর সোহরাওয়ার্দী (রহ:) তাঁকে এক মুটো মাটি দিয়ে বলেন, ‘‘স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে’’। আপন মামা ও মুর্শিদের দোয়া নিয়ে কয়েক জন সহচর সহ ইয়েমেনের পথে রওয়ানা দেন। উদ্দেশ্য ছিল জন্মভূমি দর্শন এবং মাতা-পিতা ও দাদার কবর জিয়ারত।
ইয়েমেনে বাদশাহ হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) এর আধ্যাত্মিক শক্তি পরীক্ষার জন্য তাঁকে রাজপ্রসাদে আমন্ত্রণ জানান ও বিষ মিশ্রিত শরবত পান করতে দেন। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) বিসমিল¬াহ বলে সেই শরবত পান করেন। আল্লাহ তা’য়ালার কি মহিমা বাদশাহের শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয় এবং তিনি মারা যান। আল্লাহর রহমতে বিষ পানে হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) এর কিছুই হলো না। এরপর হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) বাগদাদে যান। সেখান থেকে ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে হিন্দুস্থানে উপস্থিত হন। এভাবে প্রায় দু’বছর পথ চলার পর শেষ পর্যন্ত তিনি দিল্লীতে এসে উপস্থিত হন। দিলি¬তে আসার পর হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) সঙ্গে সাক্ষাত হয়। নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)’র আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহঃ) তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে গৌড় গোবিন্দ নামে এক হিন্দু রাজা রাজত্ব করতেন, সে ছিল অত্যাচারী। সে যুগে সিলেটে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল নগন্য। সিলেটের টোলটিকর মহল¬ায় সে সময়ে মাত্র ১৩ জন মুসলমান বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে এক জনের নাম ছিল বুরহান উদ্দিন। তিনি তাঁর পুত্রের আকীকা উপলক্ষে একটি গরু ক্বোরবানী করেন। হিন্দু ধর্মমতে গো হত্যা মহা পাপ। রাজা গৌর গোবিন্দ এ ঘটনা জানতে পেরে খুব ক্রুদ্ধ হলেন। রাজা গোবিন্দ বুরহান উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে তাঁর শিশু পুত্রকে হত্যা করেন এবং ডান হাত কেটে দেয়। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) গৌড় গোবিন্দের অত্যাচারের কথা জানতে পারলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যে সিলেট আসলেন। গৌড় গোবিন্দ মুসলিম বাহিনীকে বাঁধা দানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) এর মামা ও মুর্শিদের দেয়া আরবের মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল পাওয়ায় তারা সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। এখানে উলে¬খ্য যে, হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) মাত্র ১২ জন সঙ্গীকে নিয়ে আরব দেশ থেকে যাত্রা করেন। সিলেট আসা পর্যন্ত তাঁর শিষ্য সংখ্যা ৩৬০ জনে উন্নীত হয়। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিনা যুদ্ধে সিলেট জয় করেন। রাজা গৌড় গোবিন্দ সপরিবারে পেচাগড় জঙ্গলের দিকে পলায়ন করে। রাজার শেষ পরিণতি সম্মন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) ছিলেন সিলেটের নব জীবনের জন্মদাতা। তাঁর মতো মহৎ লোকের সংস্পর্শে এসে সিলেটবাসী ধন্য। ধন্য সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ। তাইতো মরেও তিনি অমর হয়ে রয়েছেন। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে অসংখ্য লোক প্রতিদিন হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, এমপিগণ তাঁদের নির্বাচনী কাজ সেখান থেকে শুরু করেন। রাত-দিন ক্বোরআন তেলাওয়াত, যিয়ারত, মিলাদ মাহফিল, দোয়া-দরুদ, যিকির-আযকার, ফাতেহা পাঠ করে সশ্রদ্ধ হৃদয়ে স্মরণ করে থাকেন। পৃথিবীর কোন বিখ্যাত সম্রাটগণের সমাধি সৌধেও তা হয় না। এখানে এসে আশেকানগণ লাভ করেন হৃদয়ে অনাবলি প্রশান্তি। পীর-ফকির, সাধক-দরবেশগণ লাভ করেন আধ্যাত্মিক বা রুহানী আলোর সন্ধান। আলেম উলামা লাভ করেন বাতেনী ইলমের আবেহায়াত, রুহানী ফয়েজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মাজারে ওরসকে কেন্দ্র করে মাদক দ্রব্য, মদ, গাজা, জুয়া খেলা তামাশা, হৈ-হুল্লুড়, বাদ্যযন্ত্র দ্বারা গান, নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, কবরে সিজদাসহ নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ ও শিরকী আচরণ করতে দেখা যায়। এ সমস্ত অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করা আমার, আপনার, সরকারের, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, ওরস পরিচালনা কমিটিসহ সকলের ঈমানী দায়িত্ব। নতুবা আল¬াহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে গজব আসলে শুধু তাদের জন্য আসবে না সবাই এর ফল ভোগ করতে হবে। তাই ওরসের নামে আউলিয়াদের মাজারে শিরকী, বিদয়াতী কার্যকলাপ নয় বরং শরীয়াহ্ ভিত্তিক কার্যকলাপই কাম্য।
হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) তাঁর ইন্তেকালের একদিন আগে তাঁর মুরীদগণকে ডেকে উপদেশ দিলেন তোমরা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখবে, আল্লাহকে ভয় করবে। আল¬াহর হুকুমে কাল আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিব। সত্যিই পরের দিন জোহরের নামাযে শেষ সিজদারত অবস্থায় এই মহান সাধক ১৪ মার্চ ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৯ জিলক্বদ ৭৬৪ হিজরী সনে ১৫০ বছর কোন কোন গবেষকের মতে ৬২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহী রাজিউন।
তাঁর হুজরার পাশে একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া গেল। তাতে কাফন, আতর, গোলাপজল, মওজুদ ছিল। ভক্তগণ তাঁকে যথারীতি দাফন করলেন। আল¬াহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় ওলীর রুহের চির শান্তি প্রদান করুন। তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। এবং তার উছিলায় আমাদের দেশকে ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, সাইক্লোন, সিডর, টর্নেডো এবং ভূমিকম্পের মত অন্যান্য মহামারীর কবল থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় সুন্নী ওলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেট জেলা শাখা।

 

Share





Related News

Comments are Closed