Main Menu

জীবনের জন্য সবুজের বিপ্লব

স্বপন তালুকাদর: ঘর বানাইব গাছ কাটছি,লাকড়ির দরকার পড়ছে, কাঠ কাইট্টা চুলা জ্বালাইয়া বইয়া রইছি, টাকার দরকার পড়ছে,গাছ কাটছি। খাট পালঙ্ক বানাইয়া শুইয়া রইছি।একবার কি ভাবছি কয়টা গাছ লাগাইছি। (কথাগুলো ঠিক হুবহু হয়নি) উপরের কথাগুলো একটা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন চিত্রের। যেটাতে অভিনয় করেছিল বিখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের।তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। আজ বারবার উনার কথা মনে পড়ছে। এক সময় বিটিভিতে এই বিজ্ঞাপনটি খুব প্রচারিত হতো, বৃক্ষরোপণ এবং বৃক্ষসংরক্ষণ ও জীবনের জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে। এখন সম্ভবত এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয় না।কোন বিজ্ঞাপনটি বন্ধ আছে আমার জানা নেই। পৃথিবী নামক গ্রহটির একমাত্র বিশেষত্ব হলো এখানে প্রাণ আছে, এখানে বাতাস আছে, এখানে পানি আছে। প্রাণের স্পন্দনকে ধারণ ও সংরক্ষণ করছে এই পৃথিবী। এই প্রাণের স্পন্দনের উৎসের নিবিড় সম্পর্ক সবুজের সাথে। সবুজের সাথে জীবনের,সভ্যতার নিবিড় সম্পর্ক। জীবনের সাথে জীবনের পারস্পারিকতার সাথে পরিবেশের যত নিখুঁত সম্পর্ক হবে, সবুজ ততই বিকশিত হবে। এই সবুজকে বিকশিত করতে গাছই একমাত্র অবলম্বণ পৃথিবী নামক গ্রহটির। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমগ্র পৃথিবীতে আজ সবুজের বিস্তৃতি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। যেখানে সবুজের বিকাশের অর্থই সভ্যতার বিকাশ, সবুজের বিস্তৃতির অর্থই জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। সুবজ যেখানে নিরাপদ, জীবন সেখানে সুস্থ্য প্রাণবন্ত। অথচ বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সবুজের উপর আগ্রাসন। সবুজ নিধন হচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ুর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী এই সবুজ নিধন। বৈশ্বয়িক উষ্ণায়নের মাত্রা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে ঠিক মত শীত গ্রীষ্ম অনুভূত হচ্ছে না। সবুজের বিনাশ এর অন্যতম প্রধান কারন। আমাদের বাংলাদেশের জনসংখ্যা সীমিত আয়তনের তুলনায় অত্যন্ত বেশি। কোন দেশের আয়তনের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চাল যেখানে দরকার, সেখানে আমাদের দেশে বনভূমির পরিমান ১০ শতাংশের উপরে নিতে পারছি না। যদিও সরকারি হিসেব মোতাবেক বনভূমির পরিমান ১৭ শতাংশ। যা সম্পূর্ণই কাগজে হিসেব। দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিরূপ আচরণই তা প্রমাণ করে। যেখানে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল দরকার আমরা বনভূমি ধ্বংশ করেছি। প্রয়োজনে বিনা প্রয়োজনে নির্বিচারে গাছ নিধন করছি। অথচ গাছ এমনই এক বোবা বন্ধু যে, শুধু জীবের উপকারই করে যায় সারা জীবন। বৃক্ষের মত নিবর বন্ধু মানুষের পৃথিবীতে একটিও নেই। মানুষ তথা এই জীব জগতের উপকার ছাড়া কোনরূপ ক্ষতি বৃক্ষ আমাদের করে না। এমন বন্ধুর পরিচর্চা করার মতো আমাদের দিবস সপ্তাহ ঠিক করে করতে হয়! বর্তমান সরকার ২০৩৫ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমান ২০ শতাংশে উন্নয়নের কথা বলছেন। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইতিমধ্যে প্রতি বছরই বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত হয়। তবে তা বৃক্ষরোপণ দিবস হিসেবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে, কার্যত তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। এবছর প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারে মহা পরিচালকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমপক্ষে একটি করে গাছ বিদ্যালয় আঙিনায় লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। যা ২৩ জুলাই দুপুর ১২ টা থেকে ১টা পর্যন্ত বৃক্ষরোপণ সম্পন্ন হয়, অনেক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। ফেসবুকের কল্যাণে বুঝতে পারছি, এ বছর অন্য সব বছরের তুলনায় অনেক বেশি গাছ লাগানো হয়েছে। এটাকে সবুজের জন্য বিপ্লব বলা যেতে পারে। জানি না হিসেব করলে কত লক্ষ গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতি বিদ্যালয়ে গাছ লাগানো হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে, তবে তা বিশ্ব রেকর্ডকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করবে বলে আশা করি। এই সবুজের বিপ্লবে প্রাথমিক শিক্ষক মহোদয়েরা অবদান রাখছেন, তা সত্যি আশার সঞ্চার করছে। কারন বাংলাদেশে অসাধ্য সাধনের মতো কাজ কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার কর্তৃক সম্পন্ন হয়। এক ঘন্টায় চার লক্ষাধিক গাছ লাগানো।যা অন্য কোন প্রতিষ্টানের পক্ষে সম্ভব নয়।কেননা, প্রাথমিক শিক্ষকরা স্বল্প ব্যয়ে স্বল্প সময়ে দেশের দশ কোটি ভোটারকে ডিজিটাল জাতীয় পরিচয় পত্র প্রদানের কাজটি করেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যা তারচেয়ে অনেক অনেক কম। আমার বিশ্বাস প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের পক্ষেই সম্ভব সরকার টার্গেট ২০৩৫ সালে বনভূমির পরিমান ২০ শতাংশে উন্নতিকরণের, এই সবুজ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ঠ সকলের বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়া দাবিদার। আমার আশা এবং বিশ্বাস আমরা প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার সরকারের এই সবুজ বিপ্লবকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হবে। আজ দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে উৎসবের মধ্য দিয়ে গাছ লাগানো হয় এবং এই উপলক্ষে বৃক্ষরোপণ এবং সংরক্ষণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্টিত হয় প্রতিটি বিদ্যালয়ে। যা প্রতিটি শিশুর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি ঘরে ঘরে।এতে অভিভাবকরাও গাছ লাগানো বিষয়ে সচেতন হবেন। কোমলমতি শিশুরাও বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানল। যা সত্যি অসাধারণ এক কর্মযজ্ঞ। প্রতি বছর এভাবে বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে সবুজের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে এবং বৃক্ষরোপনে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করাও দরকার। আজ বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপন করতে যেয়ে রবি ঠাকুরের শান্তি নিকেতনের কথা মনে পড়ে গেল। প্রতি বছর শান্তি নিকেতনে রীতিমত বৃক্ষের পূজো করে নাকি বৃক্ষরোপন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আসল শিক্ষা হচ্ছে তপোবনীয় বিদ্যাশিক্ষা। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শান্তি নিকেতনের পরিবেশকে অনেকটা তপোবনীয় পরিবেশেই তৈরি করেছেন। তার মতে শেখার বা বেড়ে ওঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা চাই-ই- চাই। তা আমাদের মতো জনবহুল দেশের শহরগুলোতে তো সম্ভব নয়।তবু যতটা সম্ভব প্রকৃতির সান্নিধ্য যদি বিদ্যালয়ের পরিবেশে কিছু আসে তাও কম কী?দেশকে প্রাণের স্পন্দনে আলোড়িত, আলোকিত, উদ্ভাসিত এবং উচ্ছ¡াসিত করতে বেশি করে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই। আর এই সবুজ বিপ্লবে সকলের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক। বৃক্ষরোপন যেন সপ্তাহ বা দিবসেই সীমিত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। মনে রাখতে হবে রোপনই শেষ কথা নয়, সবুজ বিপ্লবে জয়ী হতে হলে বৃক্ষের পরিচর্চা খুবই জরুরি বিষয়। অরণ্য ছাড়া জীবন অর্থহীন। পঞ্চভূতে গঠিত মানব শরীর। বনরাজি ও পঞ্চভূতের সম্মিলিত রূপ। পঞ্চভূত হলো, ক্ষিতি, অপ, তেজ,মরুৎ, ব্যোম। মাটির আশ্রয়ে আকাশ মমুখী বৃক্ষ, জল, হাওয়া ও তেজ অর্থাৎ আলোর আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। বন ছাড়া মানুষের জীবন যেন শুষ্ক। তাই কবি গুরু বলেন,
“আয়, আয় আমাদের অঙ্গনে, অতিথি বালক তরুদল।
মানবের স্নেহ সঙ্গ নে, চল আমাদের ঘরে চল।
ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে।
ইট কাঠের ভবনের মধ্যে আবদ্ধ মানুষকে দেখে কবির খেদোক্তি,
“ইটের পর ইট, মাঝে মানুষ কীট,
নাই কো ভালোবাসা, নাই কো খেলা।
আসুন জনপ্রিয় অভিনেতাআবুল খায়েরের মতে একেকটা গাছ লাগাই আর একেকটা অক্সিজেন ফ্যাক্টরি গড়ে তুলি এবং বুক ভরে বিশুদ্ধ নির্মল নি:শ্বাস নেই এবং বাঁচার তাগিদে বৃক্ষ রোপণ যেন আমাদের নিত্যদিনের জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আর কবি গুরুর সাথে সুর মিলিয়ে বলি, “দাও ফিরিয়ে দাও অরণ্য, লও এ নগর। ”

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।

 

Share





Related News

Comments are Closed