Main Menu

অব্যর্থ তীর! মেঘালয় থেকে সিলেট

শেখ ছালেহ আহমদ : যে ব্যক্তি (এক সময়) ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবিত করলাম। (তদুপরি) তার জন্য এমন এক আলোকাবর্তিকাও আমি বানিয়ে দিলাম। যার আলো দিয়ে মানুষের সমাজে যে চলতে পারছে, সে কি কখনো সে ব্যক্তির মতো হতে পারে। যে এমন অন্ধকারে (পড়ে) আছে, যেখান থেকে সে (কোনক্রমেই) বেরিয়ে আসতে পারছে না, এভাবেই কাফেরদের জন্য তাদের কর্মকান্ডকে শোভনীয় (ও সুখকর) বানিয়ে রাখা হয়েছে। সুরা- আল আনায়াম, আয়াত-১২২।
জুয়া বা লটারী একটি দোষণীয় খেলা। লোভনীয় অফারের মাধ্যামে জনসাধারণকে লটারীর দিকে আকৃষ্ট করা হয়। সমাজে কিছু বিপথগামী মানুষ লটারীতে অংশ গ্রহণ করে থাকে। কদাচিৎ দু’একজন মাঝে মাঝে বিজয়ী হয়। বাকীরা ব্যর্থ হয়। দু’ একজনের জয়লাভ দেখে অংশগ্রহণকারীর বৃহৎ অংশ আশা করতে থাকে এই বুঝি তাদের লটারীর জয়মালা ধরা দিবে। আশা-দুরাশার দোলাচলে তারা ভাসতে থাকে। আর তাদের বিনিয়োগ শুধুই বিফলে যেতে থাকে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে অনেক সময় তাদের আশ^স্ত করা হয় এই বলে যে, অচিরেই তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। সামনেই তাদের সুবর্ণ সুযোগ। এক টাকা বিনিয়োগে ৭০ টাকা লাভ। লাভটা চমৎকার। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ মানুষই প্রতারিত হয়। এখানে প্রতারণাটাই আসল খেলা। তীর খেলায় ভাগ্য বদল হয় না, শুধু নিঃশেষ হওয়া ছাড়া এখানে আর দ্বিতীয় কোন ফলাফল আশা করা যায় না।
তীর খেলার প্রচলন শুরু হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। কালক্রমে দেশের সীমান্ত এলাকা হয়ে সিলেট শহর ও তার আশে পাশে এলাকায় এই খেলাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন পেশার লোক যেমন দিন-মজুর, শ্রমিক, রিক্সা চালক, ভ্যান ড্রাইভার, শহরের ভ্রাম্যমান হকার, বস্তিবাসী ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যুবক, স্কুলের কোমলমতি ছাত্রদের একাংশ এই খেলার সাথে সরাসরি জড়িত www.teercouter.com শিলং এর মাধ্যমে এই খেলা পরিচালিত হয়। ইহা প্রযুক্তি নির্ভর একটি খেলা। স্বল্প আয়ের উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ মানুষ রাতারাতি ভাগ্য বদলের আশায় এই খেলায় ঝুকে পড়ে। আর এই শ্রেণির লোক ফতুর হতে কতক্ষণ লাগে। তাদের সঞ্চয়ই বা কি? এক একটি সঞ্চয় নিঃশেষ হয়। আর এক একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। সুন্দর স্বপ্নগুলো আত্মহত্যার মিছিল নিয়ে যেন এগিয়ে চলছে।
অপ্রতিরোধ্য লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ এক সময় দ্রত উপরে উঠার সিঁড়ি খুজতে থাকে। প্রতারক শিকারীরা তাদের লোভনীয় কৌশলের ফাঁদে ফেলে নিরীহ মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে এদেরকে সহজ শিকারের নিশানার মধ্যে আটকে ফেলে। সহজ-সরল মানুষগুলো যখন সঞ্চয় হারিয়ে এক সময় বুঝতে পারে তখন তার অর্থ ও সময় অনেক ব্যয় হয়ে গেছে। তখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে।
লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করার সহজ পথ- এমন ফটকা বাজির জৌলুসপূর্ণ প্রচারণা থেকে আপনি সতর্ক হোন। আর এখান থেকে শিক্ষা নিন। আপনি আপনাকে আটকে ফেলুন নিজের রচিত বেষ্টনির মাঝে। সঞ্চয়ের সহজ পথ আজকাল আর অচেনা নয়। ব্যাংক, বীমা আপনার নাগালের মধ্যে। আপনি ঝুঁকে পড়ুন সঞ্চয়ের সরল গতিপথে। আপনার ইচ্ছা শক্তিটাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। আমাদের ভাগ্য বদলের সহজ পথ হল জীবনের শুরুতে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা। সঞ্চয় কর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জুয়া, লটারী ও মাদক দ্রব্যের বাধাহীন প্রসারের বিরুদ্ধে কতখানি সক্রিয় ভ‚মিকা নিতে পেরেছে- তার উত্তর পেতে আমাদেরকে কি খুব বেশি বেগ পেতে হবে? না, মোটোই না। সমাজ বিরোধী কাজের ব্যাপক প্রসার আর মাদক দ্রব্যের জমজমাট ব্যবসাই বলে দেয় আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি কতটুকু শক্তিশালী? প্রযুক্তির মহাসড়কে দাঁড়িয়ে হতভাগা এক পথহারা পথিকের আহাজারির মত এ করুণ কান্না আমাদের কাম্য নয়। শক্তিশালী একটি প্রযুক্তি পারদর্শী জাতি গঠনের পথ ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বিশ^ মোড়লের গৌরবদীপ্ত আসনটি আমাদের বাগিয়ে নিতে হবে। কথায় নয়, আমরা কাজের মাধ্যমে এটা করতে চাই। তাই সেকেলে প্রচলিত কু-অভ্যাসগুলো যেমন- জুয়া, মদ, লটারী ও মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি সমূহ চিহ্নিত করে এবং অচিরেই তা পাঠ্য পুস্তকে সংযোজিত করে নৈতিক শিক্ষাকে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা। যাতে করে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন রচনার স্বপ্নিল সিড়িগুলি মজবুত করে গড়ে উঠে।
নৈতিক নিরাপত্তার দেওয়াল যতটুকু সম্ভব মজবুত করে যথেষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। এই দেওয়ালই হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের নৈতিক শিক্ষার প্রথম পাঠশালা। একটি দেশ, একটি জাতি, তাতেই একটি অখন্ড সুন্দর অবয়বে ফুটে উঠতে পারে। যেমন একটি পূর্ণাঙ্গ ফুটন্ত লাল গোলাপের মত।
রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার অভিপ্রায় নিয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়- তার সুদূর প্রসারী ফলাফল কি হতে পারে? আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা তৎকালীন আরব উপত্যকায় অন্ধকার যুগে মেয়ে শিশুদেয় জীবন্ত পূতে ফেলার মতোই একটা অপকৌশল বলে মনে হয়। তাই এমন নৈরাজ্য জনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা বিষয়ক দ্রæত গবেষণা জরুরী। গবেষণালব্ধ ফলাফলই আমাদের নিয়ে যাবে প্রযুক্তির মহাসড়কে।
জুয়া, মদ, লটারী ও মাদক দ্রব্যের প্রচলন ও ব্যবহারের অবাধ ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিতির পিছনে একটি বড় কারণ হল বাংলাদেশ ভৌগলিক অবস্থানের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার। মাদকদ্রব্য খুব সহজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে ঢুকে পড়ে। সীমান্তের ওপারের কিছু অদৃশ্য হাত ধরে এই সমস্ত নিষিদ্ধ মাদক এপারের কিছু অদৃশ্য হাতে এসে পৌছে। মাঝখানে সীমান্তরক্ষী বাহিনী দেশ রক্ষার পবিত্র শপথ নিয়ে যে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল মাদকের অবাধ প্রবেশের বদৌলতে দেশবাসী তাদের দায়িত্ব আর সেবার ষোল আনা সুফল বা কুফল যাই বলি তা হাতে হাতে নগদ পেয়ে গেল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হস্ত নরম হয়ে অপরাধ জগতের রাজমহলে প্রবেশ করে গরম কিছু পাওয়ার আশায়। একবিংশ শতাব্দীর এই মাহেন্দ্র ক্ষণে আমরা কি আশা করতে পারি না যে, এসব উদ্ভট আচরণের কবে ইতি ঘটবে?
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষত পুলিশ বাহিনীর ভ‚মিকা বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল পুলিশের চলমান আচরণ নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের আইন ও নিরাপত্তা কৌশলের পরিপন্থি বটে।
রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত বাহিনী রাষ্ট্রের তহবিল থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে। তাই দিয়েই তাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। রাষ্ট্রের আনুগত্যের শপথ নিয়ে যারা নিজের দেশের জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবন চলার গ্যারান্টি বাধাগ্রস্থ করল, আনুগত্যের শপথ খেলাপ করল, তাদের প্রতি কি পরিমাণ ক্ষোভ জানালে যথাযথ প্রতিবাদ বলে গণ্য করা হবে।
জুয়া, লটারী, মাদকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির জোরালো ভ‚মিকা পালন করা দরকার। মসজিদ, মাদরাসা, গির্জা, প্যাগোডা, মন্দিরে সর্বত্র যদি নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনগুলি মেনে চলার কড়াকড়ি তাগাদা প্রদান করা হয়, তবে তাতেও বহুলাংশে আমরা ফলাফল আশা করতে পারি। কেননা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আস্থায় নিতে মানুষ সব সময় অভ্যস্ত। মানুষের নিঃশ্বাসে ধর্ম বিশ্বাসে ধর্ম, সর্বত্রই ধর্ম আর ধর্ম। অতএব আমাদের ধর্ম গাত্রদাহের কারণ কি? ধর্মকে দোষারোপের রাজনৈতিক অভ্যাস অবশ্যই আমাদের ত্যাগ করতে হবে। পুণ্য লাভের আশায় ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পাশের গ্রামের জনৈক হিন্দু ভদ্রলোক ও তার সঙ্গী-সাথীসহ এবারের সিলেট অঞ্চলের বিশ্ব ইজতেমার আখেরী মোনাজাতে অংশ নেয়। ধর্মবৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় নিতেই তাদের এই মহৎ উদ্যোগ। তাহলে কি সত্যিকার ভাবে পৃথিবীর সকল মানুষ সত্যের সন্ধানে অগোচরে অলক্ষ্যে বিরামহীন এগিয়ে চলছে। ধর্মকে নিজেদের হীন স্বার্থে পরিচালিত করা কিংবা ধর্মের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করা- এই দুই ধারার কোনটিই আমাদের কাম্য নয়।
কোন রাজা মহারাজার হুংকারে ধর্ম বিলীন হবার নয়। বরং আপনি যদি চোখ খুলে দেখেন, তবে পৃথিবীতে অধর্মই বিলীন হবার অসংখ্য কাহিনী আমাদের কাছে প্রমাণ স্বরূপ প্রকাশ পাবে। আ’দ ও সামুদ জাতি সহ অসংখ্য শক্তিশালী জাতির ধ্বংস কাহিনী ইতিমধ্যে পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। যে কোন দেশের বিশেষ কোন অঞ্চলে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ঐ অঞ্চলের জনসাধারণকে সংঘটিত করে সামাজিক প্রতিরোধ ও প্রতিকার সর্বাগ্রে জরুরী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজপতিদের সমন্বয়ে একটি বহুমুখী কৌশলপত্র প্রণয়ন সাপেক্ষে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জোরালো প্রচেষ্টার মধ্যে নিহিত আছে সফলতার আসল চাবিকাঠি। কিন্তু দুভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, জনপ্রতিনিধি ও সমাজপতিদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিরোধ আর প্রতিকারের বদলে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল হিসাবে বিবেচিত হয়। যা আমাদের কাঙ্খিত চাহিদার বিপরীত মেরুর লজ্জাজনক আত্মপ্রকাশ ঘটে। অপরাধী কর্তৃক নজরানা প্রদান সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যা অপরাধের বিস্তৃতি ঘটাতে কৌশলগত সহায়ক বটে। অপরাধ আর অপরাধীর সাথে সখ্যতা- এই অবাঞ্চিত অবস্থা সমাজ নামক দেহটার মেরুদন্ডে পচন শুরু হয়। নজরানা প্রদানের হীন অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কি? রাজনৈতিক আর সামাজিক কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্ত দুষ্কর্ম থেকে হয়তো আমাদের পরিত্রাণ মিলতে পারে।
জঙ্গিবাদ যেভাবে আমাদের জাতি সত্তার মূলে আঘাত হানল, তাতেই আমাদের অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে পড়ে। আর তাই বিচার বিশ্লেষণের নিরঙ্কুশ মানদন্ডে ভয়াবহতার দিক দিয়ে তীর খেলা ও মাদকের প্রসার জঙ্গিবাদকেও হার মানায়। অতএব পরিশেষে অহরহ জবানবন্দী প্রদানের নালিশ সভায় বিরতিহীন বক্তব্যের সমাপ্তি রেখা টেনে নিলে কেমন দেখায়? যবনিকার প্রস্তুতি পর্বে আমরা কি আশা করতে পারি না- অসুন্দর আর অসত্যের নির্লজ্জ উত্থান চুরমার হতে কত দিবস, কত রজনী গত হলে, কত বিধবার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হলে, কত পথিকের পথচলা থেমে গেলে তবেই আমাদের পথচলা নিষ্কন্টক হবে। আমিন! ছুম্মা আমিন!!
লেখক: সমাজকর্মী, তেলিরাই, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।

Share





Related News

Comments are Closed