Main Menu

নদী খনন না করলে দূর্যোগের কবলে পড়বে দেশ

এ এইচ এম ফিরোজ আলী: পানির অপর নাম জীবন। বিজ্ঞান বলছে, বিশুদ্ধ পানির নাম জীবন। যে নামে-ই পানিকে সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন পানি ছাড়া জীবন চলে না। পানির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক গভীর। পৃথিবীর চার ভাগের তিনভাগ পানি, মানুষের শরীরের অনুপাতও একই। পৃথিবীর যত পানি তার প্রায় ৯৭ দশমিক ৫ভাগ পানি সমুদ্রের লোনা। বাকি আড়াই ভাগ পানির দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি পানি বরফ হয়ে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। বাকি পানির তিন চতুর্থাংশ ভূগর্ভস্ত পানি। মাত্র শুন্য দশমিক তিনভাগ পানি থাকে নদ-নদী, খাল-বিল পুকুর, নালা জলাশয় ইত্যাদিতে। অতএত পৃথিবীর মোট পানির শতকরা একভাগেরও কম পানি পানযোগ্য। পৃথিবীতে পানির এত প্রাচুরয্যের মধ্যে বাস করেও ক্রমেই পানি আমাদের জন্য একটি দূর্লভও ব্যয়বহুল পন্যে পরিণত হয়েছে। প্রাণ ছাড়া পানি বাঁচে। কিন্তু পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না। খাদ্য উৎপাদন শিল্প কলকারখানা উৎপাদন, পরিবেশ রক্ষা, জীব-বৈচিত্র তথা জগৎ টিকিয়ে রাখতে পানির কোন বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশে^ প্রায় ৬৫ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানির অভাবে কিংবা দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে বিশ^ব্যাপী প্রতি দুই মিনিটে একটি করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। দুনিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মিটা পানি একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ৪০ ভাগ পানি কোনো না কোনো অববাহিকা সংক্রান্ত মতানৈক্যের মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার মতে ২০২১ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ১৮০ কোটি মানুষ চরম পানি স্বল্পতার মুখে পড়বে। পানি যথেচ্ছও অপব্যবহার করলে ২০৩০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে ৪০ভাগ পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ইউনিসেফ বলেছে, নদী মাত্রিক দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশ বৎসরের অর্ধেক সময় চর্থুর দিকে পানি থৈ থৈ করতো, সে দেশের জন সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ সুপেয় পানির জন্য এখন হাহাকার করছেন। শুধু তাই নয় আর্সেনিক দূষণের ঝুকিতে আছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত জন সংখ্যার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

পানি আল্ল­াহর দানকৃত নিয়ামত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সময়ের প্রয়োজনে পানি আমাদের এখন প্রধান সম্পদ। ভারতের সাথে ৫৪টি এবং মায়ানমারের সাথে ৩টি নদী সহ মোট ৫৭টি আন্তজার্তিক নদী রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের তথ্যমতে এসব নদীর সাথে সংযোগকারী বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে ৭০০টির মত ছোট বড় নদী ছিল। এগুলোর আয়তন দৈর্ঘ্য ২২ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার। গণমাধ্যমের তথ্যমতে এসব নদীর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে ৬৭টি, পশ্চিমাঞ্চলে ১২টি এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে ৩২টিসহ প্রায় ১২৮টি নদ-নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৭টি নদী সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে। এসব নদীর সাথে সংযোগকারী খাল-বিল, নালা- ডোবা, জলাশয় বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রধান বড় বড় নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলি, তিস্তা, খোয়াই, মনু, ফেনি, বুড়িগঙ্গা, সুরমা, কুশিয়ারা, কালনি, শিতলক্ষা, বালুসহ অসংখ্য নদীর বুকে ধূ-ধূ বালুচর ও ময়লা আর্বজনার পাহাড়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদী পথ ছিল। সেই পথ কমে গিয়ে এখন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পথ রয়েছে। এর মধ্যে শীত মৌসুমে মাত্র ৩ হাজার ৮শ কিলোমিটার নৌ পথ সচল থাকে। আভ্যন্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বি আই ডব্লিউ টি এ) নদী সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে জার্নেল নামে এক পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর গতিপথ চিহ্নিত করেছিলেন। জার্নেলের সেই মানচিত্রের সাথে বর্তমান মানচিত্রের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে বিগত ২ শত বছরে নদীগুলোর প্রবাহ পথ পরিবর্তন হয়ে বহু নদী-উপনদী, শাখা নদীর মৃত্যু হয়েছে।

নদী ও পরিবেশ গবেষকরা মনে করেন, বৈশি^ক উষ্ণায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের যে ভয়াবহ দূর্যোগ আনছে, তার মধ্যে নদী হত্যা এর অন্যতম কারণ। অবৈধভাবে নদী দখল, দেশের সরকারী, বে-সরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিকের কঠিন বর্জ্য, শিল্প কলকারখানার বর্র্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য, পলি মাটি, পলিথিন ব্যাগ, প্লাষ্টিক, মল মুত্রসহ সকল প্রকার আর্বজনা ফেলে নদী ভরাট ও দূষণ করা হচ্ছে। প্রকৃতি নয়, মানব সৃষ্ট দূষণের কবলে পড়ে গত ৩ যুগে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নদী পথ বিলীন হয়েছে। নদী মরে যাওয়ায় জলবায়ূর পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে সময় মত বৃষ্টিপাত হয় না এবং নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্ত পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। রাজধানী ঢাকার চার পাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু এই চারটি নদী দূষণ ও নির্মম দখলের শিকার হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের দিকে দাবিত হচ্ছে। আশংকা করা হচ্ছে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ঢাকা বসবাসের অনুপযুগি হয়ে পড়বে।

প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ নদ-নদীর তীরবর্তী সমতল ভূমিতে বসবাস শুরু করেন। পৃথিবীর সকল সভ্যতাও জনবসতি গড়ে উঠার পিছনে নদ-নদীর ভূমিকা অনেক বেশি। নদীর সাথে মানুষের সম্পর্ক মায়ের মত। মা, মাটি-নদী পানি এক ও অভিন্ন। মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, বহুমাত্রিক এবং নিবিড়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার সর্বাধিক বিস্তার ঘটেছে নদীগুলোর তীরে। শিল্প কারখানা, নগর, বন্দর, ব্যবসা, বাণিজ্য, পন্য পরিবহন, খাদ্য উৎপাদন মাছ ধরা মানুষের জীবন-জীবিকা সবকিছু ছিল নদী নির্ভর। নদী নিয়ে গান, কবিতা, প্রবন্ধ কত কিছু রচিত হয়েছে। নদী-মাছে ভাতে বাঙ্গালির আদি উৎস। নদী বাংলাদেশের মানুষের রোজগারের প্রধান হাতিয়ার। মহাকবি মাইকেল মধুসুদনদত্ত সুদুর ফান্সে গিয়েও কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেননি’। ‘বহু দেশে দেখিয়াছি বহুনদ দলে, কিন্তু এ স্নেহের তিষ্ণা মিটে কার জলে, এ দুলাইন পংতি দিয়ে কবি কপোতাক্ষ নদকে অমর করে রেখেছেন। আমি কবির সেই কপোতাক্ষ নদ দেখে এসেছি।

বলা হয় পানির প্রধান উৎস সমুদ্র। সূর্যের তাপে খাল-বিল নদী-নালা পুকুর জলাশয়ের পানি বাষ্প হয়ে এবং সমুদ্রের পানি প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে বাষ্প আকারে আকাশে গিয়ে মেঘ জমে এবং সেই মেঘ বৃষ্টি আকারে পৃথিবীতে পতিত হয়। আবার সেই পানি নদ-নদী দিয়ে সমুদ্রে চলে যায়। এ অবস্থাকে পানি চক্র বলা হয়। নদী মরে যাওয়ায় বাতাসে জলিও বাষ্প কম এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে সময়মত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। ফলে ভূ-গর্ভস্ত পানিরস্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বৃষ্টিপাতের অভাবে বনভূমি উজাড় হওয়ায় বাংলাদেশের পাখি, সরীসুপ, উভয়চর, সুস্বাদু পানির মাছ চিংড়ি সহ ২হাজার ১শত ১৯প্রজাতির মধ্যে ৩৯০ প্রজাতির প্রাণী কোনো না কোনোভাবে হুমকির মুখে আছে। নদী মরে যাওয়ায় মানুষ পানির জন্য নলকূপ নির্ভর হয়ে পড়েছেন। ফলে শহর গ্রামে হাজার হাজার নলকূপে শীতকাল থেকে ৬মাস পানি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলে নলকূপের আশপাশে ল্যাটিনের ময়লা ট্যাংকি থাকলে এ ট্যাংকির পচা ময়লা দূর্গন্ধযুক্ত পানি আসে।

আদিকাল থেকে নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষ বাঁশ দিয়ে বস্তার পর্দা, কলাপাতা, সুপারি গাছের পাতা টানিয়ে নদীর তীরে ল্যাটিন তৈরি করে নদীর পানি দূষণ করতেন। একজন গৃহীনিও ছোট শিশুর মল, কাগজ, কাপড়, পাতা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলে নদী দূষণে সহায়তা করেন। মৃত পশু পাখির দেহ, অজ্ঞাত মানুষের লাশ, ময়লা আবর্জনা, হোটেলের ছাই ফেলার স্থান হচ্ছে নদী। কোন কোন ধর্মের লোকদের নদীর চরে লাশ দাহ করে থাকেন। গত দুই যুগ ধরে নদী ভরাট করে দখলের প্রতিযোগীতা হচ্ছে। প্লাষ্টিক, পলিথিন, পানির বোতল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জসহ লাখ লাখ টন ভয়ংকর বর্জ নদীতে ফেলে নদীকে খুন করা হচ্ছে। নদী মানুষের উপকার করলেও নদীর কান্না কেউ শুনছেন না। এক সময় নদীকে মানুষ অবহেলা করলেও এখন নদীর গুরুত্ব ঠিকই বুঝতে পারছেন। সাভাবিক পানির প্রবাহে অপরিকল্পিতভাবে ব্রীজ, কালভার্ট সেতু নির্মাণ করে বাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্ষাকালে ভারত থেকে আসা পানি ধারণ করতে পারে না নদী। ফলে দু’কুল প্লাবিত হয়ে অকাল বন্যা হয়। আবার শীতকালে নদীতে পানি না থাকায় বিপর্যয়ের মুখে পতিত হচ্ছে কৃষিনির্ভর আমাদের এই দেশ। খাবার পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গ্রাম শহরের মানুষ কড়া মূল্যে বোতলের পানির উপর নির্ভর হচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের শতকার ৮০ভাগ শিশু সাতাঁর জানে না। পানির কারণে। ফলে পর্যটনস্পটসহ বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিসহ তরুনদের করুন মৃত্যু হচ্ছে। গ্রাম বা শহরে পানির অভাবে আগুনে পুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া ওযু, গোসল কিংবা ধর্ম-কর্ম হয়না।

দেশে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। রেল পথের আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু নদী পথ ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নদ-নদী খাল বিল জলাশয় সবগুলো সরকারের ভূমি মন্ত্রনালয়ের। তাই অবৈধভাবে দখলকৃত সকল নদী উদ্ধার করা সরকারের দায়িত্ব। ঢাকার নদী উদ্ধারের জন্য নৌ পরিবহণ মন্ত্রনালয় স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে তিন স্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ঢাকার মত দেশের সকল নদী বাঁচাতে জার্নালের মানচিত্র কিংবা এসএ রেকর্ডের মানচিত্র অনুসারে সকল নদী সীমানা চিহ্নিত করে ফিলার বসিয়ে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে পদ্মা সেতুর মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করে সকল নদ-নদী খনন করে নদীর জীবন যৌবন ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তা না করা হয়, তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে পানির দেশের মানুষ পানির অভাবে বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবেন। এদেশে অনেক নতুন নতুন আইন হচ্ছে কিন্তু নদী উদ্ধারে কোন আইন নেই কিংবা প্রচলিত আইনেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। নদী উদ্ধারে নতুন আইন কিংবা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে সরকার কঠোর অবস্থান নেবেন এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, এই শ্লোগান নিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে সকল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কলামিষ্ট

Share





Related News

Comments are Closed