Main Menu

মানুষ আর যন্ত্রের তান্ডবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে লোভাছড়া

বৈশাখী নিউজ ২৪ ডটকম: স্নিগ্ধ সুন্দর সুনীল আকাশের নিচে স্বচ্ছ এক নীলাভ জলের নদী লোভাছড়া। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ সবুজ গ্রাম আর উত্তরে মেঘালয়ের আকাশছোঁয়া সারি সারি পাহাড়। ঠিক যেনো ছবির মতই অপরূপ সৌন্দর্যময় স্থান। লোভাছড়া, সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি নান্দনিক সৌন্দর্যময় স্থান। কালের বিবর্তনে লোভাছড়া আজ পাথর খেকোদের আগ্রাসনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

যেনতেন ভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, যে কোন সময় ঘটতে পারে পাহাড় ধ্বসের মতো বিপদ। পরিবেশ অধিদফতর থেকে কয়েকবার অভিযান চালানো হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের জন্য বন্ধ করা যায়নি অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন।

সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি সদস্যদের চোখের সামনেই চলছে পাথর লুটপাটের উৎসব। সীমান্ত আইন লংঘন করে ভারতের সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি একাধিক স্থানে অবৈধ ভাবে চলছে পাথর উত্তোলনের দুর্বার প্রতিযোগিতা। পাথর খেকোদের লোলুপ দৃষ্ঠি একে একে গ্রাস করে দিচ্ছে গ্রামীণ জনপদ ফসলী জমি সবুজ বন বনানী খেলার মাঠ আর লোভাছড়া নদীর তীর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য লোভাছড়াকে ক্ষত বিক্ষত করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নদীর তীর কেটে চলছে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। ধীরে ধীরে লোভাছড়া হারিয়ে ফেলছে তার অপরূপ সৌন্দর্য্য আর আকর্ষন। গত শনিবার সরেজমিনে লোভা ছড়া ঘুরে এ দৃশ্য দেখা যায়। দেখা গেছে লোভা ছড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশকে কি ভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। নির্মল শান্ত সুনিবিড় লোভাছড়াকে কি ভাবে আঘাতে আঘাতে বিপর্যন্থ করে তোলা হচ্ছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এই রূপ ‘লোভাছড়া’ কেবল পর্যটক আকর্ষণ নয়, দেশের অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। লোভাছড়া বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লোভা নদী থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করেন। এই নদীর পাথর ও বালু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার লোভাছড়াও হতে পারতো দেশের অন্যতম ব্যস্ত পর্যটন স্থান। সঠিক নজরদারি ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলেই মনোমুগ্ধকর লোভাছড়াও হতে পারতো জাফলং, বিছনাকান্দির মতো পর্যটকদের আকর্ষণ। কিন্তু অযতœ, অবহেলা আর প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় ধ্বংসের পথে এই লোভাছড়া। অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের ফলে ভেঙ্গে যাচ্ছে লোভাছড়া নদীর দুই কুল। পাথর উত্তোলনের ক্ষেত্রে খনিজসম্পদ মন্ত্রনালয়ের অনুমতিপত্র প্রয়োজন হলেও এক্ষেত্রে এমন কিছুই মানা হচ্ছে না।

উপজেলা প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে লোভাছড়ার নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদফতর এর সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে লোভাছড়ার পাথর উত্তোলনে নদীর পাড় ভেঙে ক্ষতি সাধনের ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরদারির প্রয়োজন। এই কর্মকর্তা বলেন, দুর্গম এলাকা হওয়ায় যখন তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয়না, তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া অভিযান চালালে কার্যত কোন ফল হয় না। তাই, স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধির পক্ষে মত দেন তিনি। সচেতন মহলের দীর্ঘ দিনের দাবী ১৯৯৫ সালের পরিবেশ আইনের ৫ ধারার বিধান মোতাবেক লোভাছড়াকে ইকোনজিক্যাল ক্র্যামিনাল এ্যারিয়া যেন ঘোষনা করা হয়।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পাথর কোয়ারী থেকে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলন, খাস কালেকশন দুটোই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার জানান, বেলার পক্ষ থেকে প্রথমে ধলাই, পিয়াইন ও ডাউকী থেকে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় জ্বালানী ও খনিজ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সর্বশেষ চিঠিতে সিলেটের কোন কোয়ারীতেই বোমা মেশিন ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, পাথর কোয়ারীগুলোতে লুটপাটের উৎসব শুরু ও পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন সফল করে তুলতে কোটি কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের খবর শোনা যাচ্ছে। এমন আয়োজন পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য চরম দু:সংবাদ। এভাবে চলতে থাকলে সর্বশেষ প্রতিবাদ, বিচার ও শাস্তি প্রকৃতি থেকেই আসতে শুরু করবে। বেলা’র দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার নির্দেশনা দেন আদালত। ওই নির্দেশনা অনুসারেই জাফলংকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। এখন লোভাছড়ার উপর চলছে মানুষ আর যন্ত্রের নির্যাতন। সিলেটবাসীর দাবী লোভাছড়াকে পরিবেশ সংকটাপন্ন ঘোষনা করে অবিলম্বে একটি উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। অন্যতায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে লীলা ভূমি লোভছড়া।

তিন-চার ফুট মাটি খুঁড়লেই পাথরের স্তর। সারি সারি পাথর সাজিয়ে রাখা মাটির নিচে। মাটি খুঁড়ে নদীর তীর থেকে তোলা হচ্ছে সেই পাথর। তীর কেটে পাথর তুলে তা স্তুপ করে রাখা হচ্ছে অনতিদূরে। কোথাও আবার নদীর তীর কেটে বড় বড় গর্ত করে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢল হলে ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথর ওইসব গর্তে আটকা পড়ে। পরে উত্তোলন করা হয় গর্তভর্তি পাথর। এভাবে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে নদীর তীর। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া নদীর দুইতীরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য।

কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পূর্বে লোভাছড়া সীমান্ত। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে এসেছে স্রোতস্বীনি নদী লোভা। বাংলাদেশের ভেতর প্রায় ৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এসে লোভা নদী মিশেছে সুরমার সাথে।

সরেজমিনে দেখা যায়- সুরমার মিলনস্থল থেকে লোভাছড়া সীমান্ত পর্যন্ত লোভা নদীর দুই তীর কেটে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। নদী তীরের যেখানে পাথরের স্তর পাওয়া গেছে সেখান থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। যেখানে পাথর পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে বড় বড় গর্ত করে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়- পাথর উত্তোলন ও গর্ত করার সাথে প্রভাবশালীরা জড়িত। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সিলেট থেকেও সরকার দলের রাজনীতিবীদরাও সেখানে গিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন। এনিয়ে মাঝে মধ্যে প্রভাবশালীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে থাকে।

এছাড়া নদী থেকে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে থাকলেও ওইসব রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ‘ট্যাক্স’ দিতে হয়। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই লোভাছড়া পাথর কোয়ারি শাসন করে আসছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
এদিকে, অপরিকল্পিতভাবে নদীর তীর কাটা ও গর্ত করার ফলে লোভাছড়া নদীর উভয় তীরের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে নদীর তীর ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। টানা বর্ষন হলে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় অফিসের পরিদর্শক পারভেজ আহমদ জানান- লোভাছড়া নদীর পার কেটে পাথর উত্তোলনের খবর তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবেন। এভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে পাথর উত্তোলন করা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এব্যাপারে বিজিবি’র ৪১ ব্যাটেলিয়ানের অধিনায়ক শাহ আলম বলেন, লোভাছড়ার পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশবাদীদের আরো স্বেচ্ছার হতে হবে। এব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে আরো আন্তরিক হতে হবে। লোভাছড়ার সৌন্দর্য্য রক্ষার প্রয়োজনে বিজিবি সকল প্রকার সহযোগিতা করে যাবে।

Share





Related News

Comments are Closed