Main Menu

ইলিশ-পান্তা অত:পর নববর্ষ

স্বপন তালুকদার: দুদিন পর পহেলা বৈশাখ।বাঙালি জাতির এক আনন্দ ও গৌরবের দিন। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ,নেত্রকোণসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিগত বোরো ধান অকাল বন্যা ও কিছু দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা এবং তাদের ঠিকাদরদের দুর্নীতির কারনে ঠিক সময়ে বাঁধ মেরামত না হওয়ায় তলিয়ে যায়। বর্তমান সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতায় এসব অঞ্চলের কৃষক স¤প্রদায় ফসল হারানোর অপরিসীম কষ্ট বুকে নিয়ে বছরটা কাটিয়েছেন।যে কষ্টের কোনো শান্ত্বনা হয় না।তাদের কাছে বৈশাখ মানে ফসল কাঁটার উৎসব।তাঁদের কাছে পহেলা বৈশাখ অন্য রকম আনন্দের।যা গতবার তাঁদের জীবনে আসেনি।মোগল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য পহেলা বৈশাখে হালখাতা নামে যে অনুষ্টানের রীতি প্রচলন করেছিলেন তা এই পহেলা বৈশাখে বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে।তা গ্রাম বাংলায় বছরের পর চলে আসছে। আমি সম্রাট আকবরের হালখাতা অনুষ্টান নিয়ে আমার আলোচনার বিষয় নয়। তবে ঐ সুত্র ধরেই গ্রামীন বাজারগুলোতে হালখাতার অনুষ্টান হতো এখনও হয়। হয়তো আগের মতো নয়, হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আমি যখন ক্লাশ ফোর ফাইভে পড়তাম তখন আজমিরীগঞ্জ বাজারে বাবা, কাকা,জেঠুদের সাথে যেতাম হালখাতা অনুষ্টানে। শুধু আমি নই, আমাদের এলাকার অনেক ছোটরাই তাদের বাবা চাচাদের সাথে যেতো।নতুন বছরে হালখাতা অনুষ্টানে যাওয়ার আসল আকর্ষন ছিল নতুন কাপড় ও মহাজনদের আপ্যায়নের মিষ্টি ও দই বাতাসা।আশির দশকে মানুষের হাতে তেমন টাকা পয়সা মজুদ থাকত না সব সময়।তাই সারা বছরে ঐসব মহাজন, দোকানদার কাছে থেকে বাকীতে সদাই করা হতো বা বিভিন্ন সমস্যায় টাকা সুদে ঋণ নিতেন।ঋণ ও বকেয়া পরিশোধের জন্য উক্ত দিনটি নির্ধারিত থাকত। নানা রকম মিষ্টি, বাতাসা, দই দিয়ে এইদিন মহাজনেরা তাদের আপ্যায়ন করতেন। এখনকার মতো ইরিধানের চাষ তেমন হতো না,শাইল, রাতাধান, লালডিঙ্গি, টেপিধানের চাষ বেশি হতো। যা তাড়াতাড়ি পেকে যেত। তেমন বন্যায় ফসলহানি হতো না।এখন উচ্চ ফলনশীল জাতীয় ধান পুরোটা দখল করে নিয়েছে।বাংলা বছরের শেষদিনে চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পালন করে আসছে।এইদিনে গ্রামে গ্রামে মেলা বসত।মেলায় নাগরদোলা, ছোটদের খেলনা, কৃষিকাজের নানা জিনিসও থাকত মেলায়।পুতুল নাচ ছিল মেলার আকর্ষন।এভাবে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হতো।পরের দিন বাংলা নববর্ষ শুরু।এই নববর্ষ বাঙালির নিজস্ব উৎসব। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক দেশ ও জাতির নিজস্ব একটি বর্ষ পঞ্জিকা আছে। প্রত্যক বাড়িতে নানা পদের খাবারের আয়োজন করা হতো।বছরের প্রথম দিন বলে কথা,এমনদিনে ভালোমন্দ কিছু না হলে কি চলে!এইদিন ভালো খাওয়া পড়া মানে সারা বছর ভালো খাওয়া পড়া বলে একটা কু-সংস্কারও কাজ করত না যে তা নয়।তবে বড় কথা হলো,এই আনন্দ উৎসবের ভিড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যেতো ফসল তোলার কাজে এবং কাজের চিন্তায়।এই সময়টায় প্রকৃতির খেয়াল কখন কি বলা বাহুল্য, বছরের এই সময়টাই প্রকৃতি বেশি কামখেয়ালি হয়ে উঠে। কখন আবার কাল বৈশাখীর তান্ডব নৃত্য শুরু হয়।পহেলা বৈশাখে খাবারের মাঝে ছিল দুধ, দই, পিঠা পায়েশ,নানা প্রকারের মাছ পবদা, বোয়াল, রুই, কৈ, রুই, সরপুটি, চিংড়ি ইত্যাদি মাছের নানা পদের তরকারি আর হয়ত কারো কারো বাড়িতে খাসির মাংস।তখন গ্রাম অঞ্চলে ইলিশ পাওয়া দুস্কর ছিল।তাই ইলিশ ভাজা পান্তার সাথে খাওয়া কল্পনায় ছিল না।আর পান্তার সাথে ইলিশ ভাজা কেন খাবেন,এমন দিন বাসি খাবার, হতেই পারে না।তাছাড়া অন্য কোনদিনেও ইলিশ নয়,পান্তার সাথে লংকা পুড়া বা কাঁচা লংকায় পান্তা।যা বৈশাখের দাবদাহ থেকে শরীর বাঁচাবে।তার মানে এই নয় যে, ইলিশ ভাজা আর পান্তায় নববর্ষ উদযাপন করা যাবে না।তবে এটা ইলিশ সংরক্ষণের সময়।
এখন আসা যাক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথায়। সংস্কৃতি আসলে একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, একটি জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল।এটি মানুষের জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ, সমাজ দর্পনের স্বচ্ছ দর্পন।এ দর্পণে তাকালে কোন সমাজের মানুষের জীবনাচার, জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।অন্য কথায়,সমাজ মানুষের জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গি, আর মূল্যবোধ বিবেচনা থেকেই সে সমাজের সংস্কৃতি জন্মলাভ করে।তবে সংস্কৃতি এমন কোন জিনিস নয় যে, একটি ছাচে গড়ে উঠলে, তার কোন পরিবর্তন করা যাবে না। বরং সমাজ ও জীবনের পরিবর্তনের এবং সময়ের ধারায় সংস্কৃতি পরিবর্তিত হতে পারে।ঐতিহ্য মূলত আঞ্চলিক। আধুনিকতা মূলত সীমানা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া।ঐতিহ্য প্রবাহিত হয় উত্তরাধিকার সুত্রে। আধুনিকতা প্রবাহিত হয় আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে।মানুষের ইতিহাস মূলত বিভিন্ন অঞ্চলের ও জনপদের আঞ্চলিক ইতিহাস। আমাদের বাংলা নববর্ষ বাংলা জনপদের আঞ্চলিক ইতিহাস ঐতিহ্যের বহি:প্রকাশ।আমাদের এই জনপদের মানুষের অস¤প্রদায়িক ধর্ম নিরোপেক্ষ উৎসব।বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়,তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে।বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সংস্কৃতি বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের, সকল বাঙালির এক সর্বজনীন উৎসব।আমরা বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করি।বাংলা ভাষা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্বের শেষ নেই। আমাদের গর্বের কারন হচ্ছে, আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মার্তৃভাষাকে প্রতিষ্টা করতে পেরেছি এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছি স্বাধীন ভূ-খন্ড বাংলাদেশ বাঙালি জাতি রাষ্টের।পাকিস্থান সরকার ছিল বাংলা বিদ্বেষী। তাদের ধারণা ছিল বাংলা হিন্দুদের ভাষা। তাই পূর্ব পাকিস্থানে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের শিল্পীগোষ্ঠী এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাঙালি কবি গুরু রবি ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ গানটি দিয়ে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্টান শুরু করেন ১৯৬৭ সালে। আর হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি, কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের ধারক বাহক বাঙালি।এর চিরায়িত রূপ ফুটে ওঠে বাংলা নববর্ষের দিনে।বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসব এতটা আকর্ষনীয় মাত্রায় দেখা যায় না। হালের হালখাতা অনুষ্টানটির স্থান দখল করে নিয়েছে পান্তা ইলিশ,বিপনী বিপনী ঘুরে বেড়ানো। ইলিশ মাছে চাহিদা বেড়ে যায় এইদিনটিকে ঘিরে।পুজিবাদের ছোঁয়ায় ইলিশ সংরক্ষণের সময় ব্যাপক হারে ধরা হচ্ছে ইলিশ। ঝাটকা ইলিশ পোনাও বাদ পড়ছে না।যাক সে কথা, বাংলা নববর্ষে পান্তার সাথে ইলিশ ভাজা খেতে হবে তার তো কোনো মানে হয় না। আমাদের সংস্কৃতিতে ইলিশ তো একমাত্র মাছ নয়।তাই একটা এক কেজি ওজনের ইলিশের দামের তিনভাগের একভাগ দাম দিয়ে এক কেজি সরপুটি, টেংরা, কৈ,এমনি গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়।এসব মাছ কি সুস্বাদু কম হবে?কৈ বা সরপুটির দোপেঁয়াজো অথবা চিংড়ির মালাইকারি কম কিসে ইলিশের থেকে।এবার থেকে না হয় সরপুটি, কৈ, চিংড়ির দোপেঁয়াজো,চ্চচরি আর মালাইকারিই হোক।
গিন্নিদের জন্য আস্ত রসুনে কই মাছের দোপেঁয়াজার রিসিপি
উপকরণ: কই মাছ ৫টি, আস্ত রসুনের কোয়া ১৫-১৬টি, রসুন বাটা ১ চা-চামচ,পেঁয়াজ বাটা২ টেবিল-চামচ, হলুদ গুঁড়া ১ চা-চামচ, মরিচ গুঁড়া ১ চা-চামচ, জিরা বাটা আধা চা-চামচ, ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল-চামচ, কাঁচামরিচ (ফালি) ৩-৪টি, লবণ স্বাদমতো, তেল প্রয়োজনমতো, পানি অল্প।
প্রণালি: মাছ কেটে ধুয়ে তাতে লবণ, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া ও রসুন বাটা মেখে তেল দিয়ে লাল করে এপিঠ-ওপিঠ ভাজুন এবং তুলে রাখুন। কড়াইয়ে পরিমাণমতো তেল দিয়ে তাতে পেঁয়াজ বাটা, মরিচ গুঁড়া, হলুদ গুঁড়া, জিরা বাটা, লবণ ও সামান্য পানি দিয়ে কষিয়ে নিন। কষানো হলে ১ কাপ পানি দিন। আস্ত রসুনগুলো দিন। পানি ফুটে উঠলে ভাজা কই মাছগুলো দিন। ঝোল ঘন হয়ে এলে ধনেপাতা ও কাঁচামরিচ দিয়ে নামিয়ে নিন।খেয়েই দেখুন না এবছর। হয়তো এক সময় কৈ বা চিংড়ি মাছে মালাইকারি, কৈ মাছের দোপেঁয়াজো, কৈ মাছে ভাজিই হয়ে উঠতে পারে নববর্ষের খাবারের মেনুতে প্রধান আকর্ষন।হয়তো রমনার বটমুলে পান্তার সাথে কৈ মাছের ভাজি,মন্দ হবে কি?
শুরু করছিলাম হাওরাঞ্চল নিয়ে।গত বোরো ফসল পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলায় বর্ষবরণ অনুষ্টান হয়নি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।হাওরবাসীর দু:সময়ে পাশে থাকার জন্য।আমরা আশা করি,এ বছর ভালো মতো ফসল কাটা সম্পন্ন হবে।বোরো ফসলে ভরে উঠুক সকল কৃষকের গোলাঘর ও মন।এবারের আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি অনেকটা ভালো দেখা যাচ্ছে।কোথাও কোথাও ফসল কাঁটা শুরু হয়েছে।তবু বৈশাখ মাসের গতি প্রকৃতির কোনো গ্যারান্টি নেই।নিরাপদে হাওরাঞ্চলের মানুষ তাঁদের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন এ প্রত্যাশা করি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষবরণ গানটি দিয়েই শেষ করছি :
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…

যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো…

মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি
শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক, দূরে যাক যাক যাক
এসো এসো…
ঘুচে যাক দু:খ জরা।শুভ হোক, সুন্দর হোক নতুন বছরে সবার নতুন জীবনযাত্রা। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।শুভ নববর্ষ।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
১২ এপ্রিল ২০১৮

Share





Comments are Closed